আইন অমান্য করেই ঢাকায় জলাশয় ভরাট

জলাশয়টি ভরাট হলে বিমানবন্দরসহ আশপাশের এলাকার পানিনিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হবে। তিন মাস ধরে ভরাট চললেও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো নির্বিকার।

আইনে জলাশয়ের শ্রেণি পরিবর্তন দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বিশাল আয়তনের এ জলাশয় ভরাট করছে। এটি ভরাটের ফলে বিমানবন্দরসহ আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর আশকোনা এলাকায়
ছবি: তানভীর আহম্মেদ

রাজধানীর আশকোনা এলাকায় বিশাল আয়তনের একটি জলাশয় ভরাট করছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। আইনে জলাশয় ভরাট ও শ্রেণি পরিবর্তন করা নিষিদ্ধ। কিন্তু তিন মাসের বেশি সময় ধরে জলাশয়টি ভরাটের কাজ চললেও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো নির্বিকার।

জলাশয়টি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) দক্ষিণখান মৌজায় অবস্থিত। ডিএনসিসির কাউন্সিলর, পরিবেশবিদ ও এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকায় বৃষ্টির পানি ধারণের জন্য এর থেকে বড় কোনো জলাশয় নেই। এটি ভরাটের ফলে বিমানবন্দর, দক্ষিণখান ও উত্তরখানসহ আশপাশের এলাকায় পানিনিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হবে। বিমানবন্দরেও জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ডিএনসিসির ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে বেবিচকের কর্মীদের আবাসনসহ আরও স্থাপনা হবে। তিনি বলেন, জলাশয়টি আংশিক ভরাট হয়েছে, এখন বৃষ্টি হলে এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। পুরো ভরাট হলে বর্ষায় পুরো এলাকা তলিয়ে যাবে।

জলাশয়টি আশপাশের এলাকার বৃষ্টির পানি ধারণের বড় উৎস। এটি ভরাট করা হলে বিমানবন্দরসহ আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা হবে।
শরীফ জামিল, সাধারণ সম্পাদক, বাপা

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, আশকোনা হজ ক্যাম্পের পাশে জলাশয়টির ভরাটকাজ চলছে। ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধেক ভরাট হয়ে গেছে। কাছাকাছি একটি ভবনের নিরাপত্তাকর্মী নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আগে সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়কে কোমরপানি জমে যেত। তিনটি পাইপ দিয়ে সড়কের পানি এই জলাশয়ে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়। এর পর থেকে পানি কম জমছে। জলাশয়টি ভরাট হলে বৃষ্টির পানি সরার কোনো জায়গা থাকবে না।

মহানগরী, বিভাগীয় শহর, জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনের (২০০০) ৫ ধারা অনুযায়ী, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। এ ছাড়া এ ধরনের জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর করা যাবে না। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ।

জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, কেউ আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি আইন অমান্যকারীর নিজ খরচে সেটা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার বিধানও রয়েছে।

রাজউকের ওই এলাকার কর্মকর্তাদের সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বেবিচকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।
মো. আশরাফুল ইসলাম, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপ প্রকল্পের পরিচালক

জলাশয় ভরাট বন্ধের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, রাজউক, ঢাকা জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। কিন্তু তিন মাস ধরে জলাশয় ভরাটকাজ চললেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মনিটরিং) আবদুস সালাম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, জলাশয় ভরাটের বিষয়ে কোনো অভিযোগ তাঁরা পাননি। সরেজমিনে পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজধানীর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) আশোকানার এই জায়গাটি ‘জলাশয়’ দেখানো হয়েছে। সংশোধিত ড্যাপেও এটি জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত বলে জানিয়েছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপ প্রকল্পের পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের ওই এলাকার কর্মকর্তাদের সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বেবিচকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। আশরাফুল ইসলাম জানান, বেবিচক এ জায়গার শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনও করেনি।

জলাশয়টির মালিকানা বেবিচকের নামে। এটি ভরাটের বিষয়ে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের জন্য অনেক কিছু বদলাতে হচ্ছে। হেলিকপ্টার পোর্টসহ বেশ কিছু নতুন স্থাপনা করতে হবে। জলাশয়টি বেবিচকের আবাসিক এলাকার ভেতরের জায়গা। তিনি বলেন, এখনো ভরাটের কাজ শেষ হয়নি। জলাবদ্ধতাসহ সবকিছু মাথায় রেখে বিমানবন্দর ও আশপাশ এলাকার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে। সেটা চূড়ান্ত হলে রাজউকে আবেদন করা হবে।

সরেজমিনে দেখা যায়, জলাশয় ভরাট করে বিকল্প পানিনিষ্কাশনের জন্য ৬০ ফুট প্রশস্ত একটি লেক তৈরির কাজ চলছে। লেকটি খিলক্ষেতে অবস্থিত বনরূপা হাউজিংসংলগ্ন খালে সংযোগ করা হবে। হজ ক্যাম্পের পাশ দিয়ে এই লেক তৈরি করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

জলাশয় ভরাটের এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ জলাশয়টি আশপাশের এলাকার বৃষ্টির পানি ধারণের বড় উৎস। এটি ভরাট করা হলে বিমানবন্দরসহ আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা হবে। তাঁর মতে, সরকারের সংস্থাই আইন অমান্য করে জলাশয় ভরাট করছে, এটি মানা যায় না।