আঘাত ও বিষক্রিয়ায় জেব্রার মৃত্যু

সাফারি পার্কের বাঘ ও জাতীয় চিড়িয়াখানায় সিংহীর মৃত্যু অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণে।

তৃণভোজী প্রাণীদের জন্য খাবার পাত্রের মধ্যে দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। মাটিতে দেওয়া হয়েছে খাবার। গতকাল বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের কোর সাফারি এলাকায়
ছবি: সাদিক মৃধা

আঘাত, বিষক্রিয়া ও রোগ ছড়িয়ে পড়ায় গাজীপুরের শ্রীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের জেব্রা, বাঘ ও সিংহী মারা গেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাগার ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় প্রাণিরোগ অনুসন্ধান গবেষণাগার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের তিনটি জেব্রা মারা গেছে আঘাতে। আটটি জেব্রা মারা গেছে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া জেব্রাগুলোর মরদেহে বিষক্রিয়ার উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। সাফারি পার্কের মারা যাওয়া বাঘটি অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত ছিল। তবে সাফারি পার্কে মারা যাওয়া সিংহীর মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি।

এ ছাড়া জাতীয় চিড়িয়াখানায় একটি সিংহীর মৃত্যু হয়েছে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণে। গত বছরের নভেম্বরে সেখানে দুটি বাঘের শাবক মারা গেছে ট্রিপেনোসোমা ব্লাডপ্লোটোজোয়া রোগে। মাছির কামড়ে এ রোগ ছড়ায়।

গতকাল রোববার বিকেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক পরিদর্শনে যান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। সেখানে জেব্রার মৃত্যুর বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, খাদ্যে বিষক্রিয়া ছিল। প্রাণীগুলোকে খাদ্য দেওয়ার আগে পরীক্ষা করে দেওয়ার কথা। পরীক্ষা করা যাঁর দায়িত্ব ছিল, তাঁর ওপর দায় বর্তাবে।

শাহাব উদ্দিন বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে কারা কারা জড়িত, কারও ইন্ধনে হয়েছে কি না; তদন্ত করে বের করা হবে। ইতিমধ্যে ঘটনা উদ্‌ঘাটনে মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটি প্রতিবেদন দেবে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রাণী মৃত্যুর ঘটনায় এর মধ্যে সাফারি পার্কের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা তিন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে গত ২৫ জানুয়ারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলের দেওয়া প্রস্তাবের বেশ কিছু বাস্তবায়ন হয়নি। গতকাল সরেজমিন জেব্রার বেষ্টনী ঘুরে দেখা যায়, প্রাণীর খাবার মাটিতে না দিয়ে পাত্রে দেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও জেব্রাসহ অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীকে আগের মতোই মাটিতে খাবার দেওয়া হয়েছে। এখনো প্রাণীগুলোকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে। আরও জানা গেছে, বেষ্টনীর মাটিকে জীবাণুমুক্ত করার কাজগুলোও পুরোপুরি শেষ করা হয়নি।

গবেষণাগারের তথ্য

সাফারি পার্কে মারা যাওয়া জেব্রাগুলোর নমুনা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) পরিচালক ও সেখানকার ভেটেরিনারি অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. আবু হাদী নূর আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, সাফারি পার্কে ১১টি জেব্রার মধ্যে ৩টি জেব্রা আঘাত পেয়ে মারা গেছে। আঘাতে জেব্রাগুলোর পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল। তবে প্রাণীগুলো কীভাবে আঘাত পেয়েছে, তা তিনি জানাতে পারেননি। বাকি ৮টি জেব্রা প্রচণ্ড নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ৮টি জেব্রার শরীরে বিষক্রিয়ার উপস্থিতিও পাওয়া গেছে।

আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, জেব্রাগুলো ধীরগতির বিষক্রিয়ার শিকার হতে পারে। বিষক্রিয়ার কারণে জেব্রাগুলোর শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। ফলে তাদের শরীরে স্বল্পমাত্রায় থাকা পাস্তুরেলা, কলিফর্ম, স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়াগুলো বিস্তার লাভ করে এবং একপর্যায়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

জানা গেছে, সাফারি পার্কের ঘাসে স্বাভাবিকের বেশি মাত্রায় সিসা বা বিষ পাওয়া গেছে। সে জন্য অন্য জায়গা থেকে ঘাস এনে জেব্রাগুলোকে খাওয়ানো হচ্ছে।

আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, গাজীপুর শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এর দূষণের কারণেও ঘাসে সিসার পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। আবার অন্যভাবেও জেব্রাগুলো বিষক্রিয়ার শিকার হতে পারে। জেব্রাগুলো করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল কি না, তা–ও পরীক্ষা করে দেখা হবে।

সব প্রাণীকে টিকা দিতে হবে

গত ২৫ জানুয়ারি জাতীয় চিড়িয়াখানায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে একটি সিংহী মারা যায় বলে জানান পরিচালক মো. আবদুল লতীফ। তিনি বলেন, খাবার ও মাটির মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স ছড়াতে পারে। সে জন্য যেসব জায়গায় মাংসাশী প্রাণী থাকে, সেখানকার মাটি ৩ ফুট করে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মাংসাশী ছাড়া চিড়িয়াখানার অন্য প্রাণীগুলোকে টিকা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

গত ২০ ও ২১ নভেম্বর ৫ মাস বয়সী দুটি বাঘের বাচ্চা মারা যায়। সেগুলো ট্রিপেনোসোমা ব্লাডপ্লোটোজোয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মাছিবাহিত এ রোগ প্রতিরোধে স্প্রে করা হচ্ছে বলেও জানান আব্দুল লতীফ।

সাফারি পার্ক ও চিড়িয়াখানায় অ্যানথ্রাক্স থেকে সুরক্ষার উপায় জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সব প্রাণীকে টিকা দিতে হবে, তাহলে অ্যানথ্রাক্স ছড়াবে না। সরকারের কাছে পর্যাপ্ত টিকা রয়েছে।

শেখ আজিজুর রহমান বলেন, অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু ৯০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। তাই অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে যেসব প্রাণী মারা যাবে, সেগুলোর রক্তসহ অন্যান্য উপকরণ ১৪ ফুট মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। মাংসাশী প্রাণীসহ গবাদিপশুও অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হতে পারে।

জানানো হয়নি সচিবকেও

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক পরিদর্শনে মন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার। ৮ জেব্রার মৃত্যুর খবর মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও জানানো হয়নি জানিয়ে হাবিবুন নাহার বলেন, ‘তথ্য কেন গোপন করা হয়েছে, সে রহস্যও উদ্‌ঘাটন করা হবে।’

বিভিন্ন প্রাণীর বেষ্টনী ঘুরে দেখে সন্ধ্যার পর মন্ত্রী সাফারি পার্ক ত্যাগ করেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর-৩ আসনের সাংসদ মো. ইকবাল হোসেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল, সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক মোল্লা রেজাউল করিম প্রমুখ।