কাজলচোখা সুধুকা

সুধুকার ছবি ময়মনসিংহ থেকে তুলেছেন আদনান আজাদ

মোটরসাইকেলে চড়ে পাখি ও প্রকৃতি ভ্রমণে বেরিয়েছি আমরা চারজন। ফকিরহাট থেকে হাইওয়ে ধরে বেতাগা-চৌরাস্তা হয়ে যাব খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার বাইনতলা গ্রাম পর্যন্ত। গৌরম্ভা গ্রামটি পড়েছে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায়। একটু এগিয়ে পশুর নদের সরু একটা শাখার ওপরের ছোট ব্রিজটি পার হলেই বটিয়াঘাটার শুরু। যাত্রাটা প্রায় ৩০ কিলোমিটারের।

পাখি ও প্রকৃতি–ভ্রমণে ও প্রকৃতি-দর্শনে দেহ-মনের সব ক্লান্তি-শ্রান্তি ও দুঃখ-গ্লানির যেমন অবসান হয়, তেমনি মনপ্রাণ চাঙা হয়ে ওঠে। এই ভ্রমণে আছে নেশা ও আনন্দ। তো যাওয়ার পথে চা-বিরতি হলো, চা যখন পান করছি আমরা, তখন শুনতে পেলাম একটি বাদামি কাঠবিড়ালির ‘কট্ কট্-কিট্ কিট্’ ধরনের ডাক। একটু এগিয়েই দেখি, একটি ছাতিমগাছের ডালে বসে নিচের ঝোপটার দিকে তাকিয়ে আছে ওটা। কাঠবিড়ালিরা প্রজনন মৌসুমেও ডাকে, তবে সেই ডাকটা এত কঠিন হয় না। ওটা এই মুহূর্তে যেন আশপাশের গ্রামীণ বনের সব পাখি ও প্রাণীকে ‘সতর্কসংকেত’ পাঠিয়ে যাচ্ছে অনবরত। ঝোপটার তলায় থাকতে পারে সাপ-গুইসাপ-বেজি বা অন্য কোনো প্রাণী। হয়তোবা আশপাশের কোনো ঝোপালো গাছের মাথায় অথবা সুপারিগাছের মাথার ভেতরে রয়েছে কাঠবিড়ালির বাসা! এ সময় আচমকা একটি পাখি পরপর তিনবার কাঠবিড়ালির মাথার একেবারে ওপর দিয়ে ছোঁ মারার ভঙ্গিতে উড়ে গেল। কাঠবিড়ালি একটু নিচে নেমে বসে ডাকতে শুরু করল আবার। হতে পারে পাখিটারও বাসা রয়েছে আশপাশের কোনো গাছে, কাঠবিড়ালির ডাকটা তার পছন্দ বা সহ্য হচ্ছে না।

পাখিটার নাম ছোট দুককা, সুধুকা, কাঠকসাই। কান-চোখ জোড়ায় এদের যেন ঘন করে কাজল মেখে দিয়েছে প্রকৃতি-শিল্পী, বাগেরহাট-ফকিরহাটে তাই বুঝি নাম মইনে কাজল। ইংরেজি নাম কমন উড-শ্রাইক। বৈজ্ঞানিক নাম Tephrodornis pondicerianus। দৈর্ঘ্য ১৬ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২২ গ্রাম। বাসা বাঁধার মৌসুম এদের বসন্ত-বর্ষাকাল পর্যন্ত। আমরা পাখিটিকে আক্রমণে যেতে দেখে আন্দাজ করলাম, আশপাশে বাসা আছে ওটার। তারিখটি ছিল গত মার্চের ১১ তারিখ।

মইনে কাজল বা সুধুকারা গাছের মোটা ডালের ওপর ছিমছিমে গোলাকার বাটির মতো ছোট বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটে ছানা হয় ১৫-২১ দিনে। ডিমে তা দেওয়ার সময় এদের বুকের নিচের অংশসহ পেটের তলাটা থাকে বাসায়, ঘাড়-গলা-লেজ থাকে পুরোপুরি বাইরে।

পাখিটির মাথার তালু-ঘাড়-পিঠ ও পাখার উপরিভাগ আবছা-বাদামি, চোখের ওপর দিয়ে চওড়া সাদাটে রেখা টানা, চকচকে বাদামি গলা, বুক ও পেটও একই রঙের, লেজের উপরিভাগের গোড়া ও লেজের প্রান্ত সাদা। কালো পা ও ঠোঁট। মূল খাবার এদের শুঁয়োপোকা, অন্যান্য পোকামাকড়, ফুলের মধুরেণু ইত্যাদি। প্রয়োজনে এরা গাছের সরু ডালে ঝুলতে-দুলতে যেমন পারে, তেমনি পারে ‘অ্যাক্রোবেটিক শো’ দেখাতে। এদের ছানারাও বিপদের গন্ধ পেলে সমস্বরে ‘শোঁ শোঁ’ শব্দ করে, দুর্গন্ধযুক্ত লালা স্প্রে করে। ছানাদের শত্রু হলো কাঠবিড়ালি, গেছো ইঁদুর, ডিমছানাখেকো সাপ, শিকারি চিলবাজসহ হাঁড়িচাঁচা পাখি। সদ্য উড়তে শেখা বাচ্চাদের নিয়ে এরা কাশবন, ঘাসবনসহ আখখেত, পাটখেতে ঢোকে; বিশেষ করে শুঁয়োপোকার লোভে। শত্রু এলে চিৎকার করে ‘তে-রে-রে তিরিং’জাতীয় শব্দে।