কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সীমান্ত লাগোয়া দক্ষিণ গ্রামের নোয়াব উদ্দিন মাস্টারের বাড়ি থেকে আমরা দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। গাড়ি ছুটছে নিঝুম গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে। পথের দুই পাশে শুধু ছোপ ছোপ সবুজ। এমন চোখজুড়ানো ঘন সবুজের ভেতরেও কোথাও যেন বিরাট শূন্যতা আর হাহাকার ছড়িয়ে আছে। যেন নিশ্চুপ ঘুমিয়ে আছে গ্রামগুলো। তবু মাঝেমধ্যে চা–দোকান ঘিরে বিক্ষিপ্ত আড্ডা আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। অবশেষে গাড়ি থামল অচেনা এক স্থানে।
প্রকৌশলী আবু মুছা ভূঁইয়া বললেন, ‘এখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে একেবারেই নতুন কিছু!’ তাঁর কথায় বেশ উত্সাহী হয়ে চারপাশে চোখ রাখি। মূল ফটকে পৌঁছানোর আগেই শুভ্র কেও ফুলের একটি বড় ঝাড় চোখে পড়ে। এমন নিঝুম একটি জনপদে কেওকন্দগুলো বেশ নিরাপদে আছে। দেখে ভালো লাগল!
বাড়িটির বহির্দেয়ালে উত্কীর্ণ তথ্যফলক থেকে বুঝতে পারি, আমরা এসেছি বুড়িচং উপজেলার বুরবুরিয়া গ্রামের কুতুবুজ্জামান হজরত আপ্তাব উদ্দিন শাহ (রহ.)-এর মাজার শরিফ প্রাঙ্গণে। প্রতিবছর চৈত্র মাসের ৭ তারিখ তাঁর প্রয়াণবার্ষিকীতে এখানে ওরস হয়। মাজার প্রাঙ্গণে আমাদের স্বাগত জানালেন মো. সামসুল হক ভূঁইয়া ও হাবিবুর রহমান। তাঁরা জানালেন, এ বাড়ির বিশেষত্ব হলো দুর্লভ প্রজাতির বিচিত্র উদ্ভিদের সমারোহ। তাঁরা দীর্ঘদিন থেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে এই প্রাঙ্গণকে বৃক্ষশোভায় সুসজ্জিত করার কাজটি করে চলেছেন। বাস্তবে তার প্রমাণ পাওয়া গেল। মূল ফটক লাগোয়া গাছে অমৌসুমি আম দেখে চমত্কৃত হলাম। ননীফল নামের অচ বা হলদিকুঁচগাছটিকে ক্যানসার প্রতিষেধক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁরা। সেখানে ঘুরে ঘুরে আরও প্রায় ২৫ রকম দুর্লভ উদ্ভিদের দেখা পেলাম। উল্লেখযোগ্য হলো রাম্বুটান, অ্যাভোকাডো, পার্সিমন, টক আতা বা করোসল, ড্রাগন, কফি, কাজুবাদাম, আলুবোখারা, সূর্যডিম আম, বারোমাসি ও চিয়াংমাই জাতের আম, নাসপাতি, জিনসেং, ভেরিগেটেড মাল্টা, বারোমাসি আমড়া, বারোমাসি কাঁঠাল, ট্যাংফল, অগ্নীশ্বর জাতের কলা, মাইলাম বা মালিআম ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি পিনাট-বাটারের গাছ দেখে। এমন নিভৃত গ্রামে এসে পিনাট-বাটারের মতো একটি অপ্রচলিত উদ্ভিদ দেখতে পাব ভাবিনি। জানামতে, আমাদের দেশে খুবই সীমিত পরিসরে দু–একটি স্থানে এ উদ্ভিদ দেখা যায়।
হাবিবুর রহমান জানালেন, দুর্লভ উদ্ভিদ সংগ্রহ তাঁর নেশা। এক দশকের বেশি সময় আগে দুর্লভ উদ্ভিদ সংগ্রহ শুরু করেন তিনি। এই ধারবাহিকতায় পিনাট-বাটার সর্বশেষ সংযোজন। চিরসবুজ, দ্রুত বর্ধনশীল এ গাছ সাধারণত গুল্ম বা ছোট আকৃতির, ৭ থেকে ৮ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। চাষের গাছগুলো ৬ মিটার ব্যাস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। বাকল মসৃণ ও ধূসর বাদামি রঙের। এ গাছ শীতেও বেশ ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। পাতা চ্যাপ্টা, পেছনের দিক রুপালি ও কিনারা ঢেউখেলানো। সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে হলুদ রঙের ক্ষুদ্র আকৃতির গুচ্ছবদ্ধ ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি ফলের মৌসুম। ফল উপবৃত্তাকার, ২ থেকে সাড়ে ৩ সেন্টিমিটার লম্বা, মসৃণ, সামান্য রোমশ এবং পরিপক্ব রং কমলা বা লাল। খাদ্যাংশ সুমিষ্ট, চটচটে কমলা লাল রঙের ও গন্ধ চিনাবাদাম-মাখনের মতো। ভেতরে শক্ত একটি আঁটি থাকে। পাকা ফল সাধারণত সতেজ অবস্থাতেই খাওয়া হয়। তবে জেলি বা জ্যাম হিসেবেও সংরক্ষণ করা যায়।