চঞ্চুমোটা হরিকল
কুয়াশার চাদরে ঢাকা এক সকালে হবিগঞ্জের কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে চঞ্চুমোটা অদ্ভুত চোখের পাখিটি প্রথম দেখি। ছোট্ট একটি টিলার ওপর নাম না জানা গাছের শাখায় বসে ছিল। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে দু-তিনটি ক্লিক করতেই উড়াল দিল। কিন্তু কুয়াশার কারণে ছবি মোটেও ভালো হলো না। এরপর পাখিটিকে বহুবার দেখেছি সাতছড়ি, লাউয়াছড়া ও কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে। তবে কাছ থেকে নয়; বেশ দূর থেকে। কাজেই ভালো কোনো ছবি তুলতে পারিনি।
সিলেট বিভাগে পাখি দেখার স্থানগুলোর মধ্যে সম্প্রতিকালে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানেই সবচেয়ে বেশি ঘোরাঘুরি করেছি। বিশেষ করে পুণ্যি পুকুর, বড় পুকুর ও টাওয়ারে। একদিন টাওয়ারের পাশের লাল মান্দার ফুলের ওপর বসা অবস্থায় পাখিটির ছবি তোলার আশায় ওখানে ভোর থেকে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সোনাকুলি, কাঠশালিক, শ্বেতাক্ষী, কালোমাথা বুলবুলি ইত্যাদির দেখা পেলেও চঞ্চুমোটা অদ্ভুত চোখের পাখিটিকে মান্দার ফুলে বসতে দেখলাম না। মান্দার গাছের আশপাশ এবং ওপর দিয়ে বুনো পায়রাগুলো ওড়াউড়ি করলেও কখনোই মান্দারের টকটকে লাল ফুলে ওদের বসতে দেখিনি।
যাহোক, সেদিন বেশিসংখ্যক আলোকচিত্রী ও অন্যান্য মানুষের ভিড়ে টাওয়ারের কাছের মান্দার গাছে বেশি সুবিধা করতে পারলাম না। তাই মান্দারের উল্টো পাশের গাছগুলোর দিকে ক্যামেরা তাক করে দাঁড়িয়ে রইলাম। সকাল ঠিক ৮টা ২৬ মিনিটে একটি বুনো পায়রা ওখানকার একটি ন্যাড়া গাছে এসে বসল। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে মনটা খুশিতে নেচে উঠল। আরে, এটা তো সেই চঞ্চুমোটা পাখিটি। সময় নষ্ট না করে দ্রুত কয়েকটা ক্লিক করলাম। ছবি মোটামুটি মানের হলো। এতেই আমি খুশি।
চঞ্চুমোটা অদ্ভুত চোখের এই পাখি এ দেশে সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক বুনো পায়রা হরিকল। পশ্চিমবঙ্গে বলে ঠোঁটমোটা হরিয়াল। ইংরেজি নাম থিক-বিল্ড গ্রিন-পিজিয়ন বা থিক-বিল্ড পিজিয়ন। কলাম্বিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Treron curvirostra। ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ হয়ে চীন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন পর্যন্ত পাখিটির আবাস এলাকা বিস্তৃত।
হরিকলের দৈর্ঘ্য ২৫-৩০ সেমি এবং ওজন ১৭০-১৯০ গ্রাম। পায়রা-পায়রির চেহারায় পার্থক্য রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক পায়রার ঘাড় ও মাথা জলপাই-বাদামি। ডানা-ঢাকনি তামাটে-মেরুন। পিঠের নিচে জলপাই ও সবুজের মিশ্রণ। বুক, পেট ও ডানার প্রান্ত হলুদাভ জলপাই-বাদামি। লেজতল-ঢাকনি হালকা দারুচিনি রঙের। অন্যদিকে পায়রির পিঠ জলপাই-সবুজ এবং তাতে তামাটে রং থাকে না। লেজতল-ঢাকনিতে সবুজ ডোরা থাকে। পায়রা-পায়রিনির্বিশেষে মোটা চঞ্চুর গোড়া লাল ও আগা সবুজ, ডানায় সুস্পষ্ট হলুদ ডোরা ও অক্ষিগোলকের খোলা অংশ উজ্জ্বল সবুজ। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল প্রবাল লাল। পালক অনুজ্জ্বল ও মাথা অতিরিক্ত জলপাই।
এরা পাহাড় ও টিলাময় বনাঞ্চল, বাগান ও লোকালয়ের প্রান্তে বিচরণ করে। সচরাচর দলে থাকে। ভোর ও গোধূলিতে বেশি তৎপর। বট, পাকুড়, জগডুমুর এবং অন্যান্য রসাল ছোট ফল খায় দল বেঁধে। গাছ থেকে নিচে পড়া ফল খাওয়া ও পানি পান করা ছাড়া সচরাচর মাটিতে নামে না। জোরে ডানা ঝাঁপটিয়ে দ্রুতগতিতে ওড়ে। পায়রা ‘গু-গু-গু...’ শব্দে ডাকে।
মার্চ থেকে আগস্ট প্রজননকাল। এ সময় ঝোপঝাড়, বাঁশঝাড় ও গাছের দো-ডালায় বা তে-ডালায় সরু ডালপালা দিয়ে ঢিলেঢালা মাচার মতো বাসা বানায়। ডিম পাড়ে দুটি, রং সাদা। পায়রা-পায়রি উভয়েই ডিমে তা দেয় এবং ছানাদের খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে তোলে। ডিম ফোটে ১৮-২১ দিনে। আয়ুষ্কাল ৪-৫ বছরের বেশি।