নিশিবকের ছবি রাজশাহীতে পদ্মার চর থেকে তুলেছেন মো. মারুফ রানা।

জোড়ার বিলের পারে পাশাপাশি দুটি শতবর্ষী শিরীষগাছ ছিলÑসেই ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। বিলটির অবস্থান ছিল বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বোলতলী গ্রামসহ আরও কয়েকটি গ্রামজুড়ে। বিলপারের এক গেরস্তবাড়ির আঙিনার ওই দুটি গাছে ছিল নিশিবকের স্থায়ী আবাস বা আস্তানা। জোড়ার বিলে শীতকালে নামত মানিকজোড়, শামুকভাঙা ও কয়েক প্রজাতির বুনো হাঁস। তাই আমার শিকারি বাবার সঙ্গে প্রায়ই যাওয়া হতো পাখি শিকারে। গুলিতে আহত-নিহত পাখি কুড়াতাম আমি। কিন্তু ওই ‘নিশিবক বাড়িতে’ কখনো নিশিবক শিকার করা যায়নি। পাখি ও গাছপ্রেমিক ওই বাড়ির প্রবীণ মালিক নিশিবকগুলোকে বুকে আগলে রাখতেন। বাসার মৌসুমে ওই মালিক গাছের তলা থেকে বকের ডিম-বাচ্চাও কুড়াতেন না। তবে বাবার সঙ্গে বিলে গেলে ওই মৌসুমে ডিম-বাচ্চা কুড়াতাম আমরা। ঝড়–বৃষ্টি হলে তো বন্দুক ছাড়াই যেতাম। এতে ওই মালিকের কোনোই আপত্তি ছিল না। আপত্তি ছিল না শিয়াল-খাটাশ-বনবিড়াল ও গুইসাপে ডিম-ছানা খেলে।

এই যে এত পুরোনো কথা বলছি, তার কারণ করোনাকালের শুরু থেকেই আমি আমার ৯ বছরের নাতি অর্নিভকে নিয়ে ‘ঘরবন্দী-ছাদবন্দী’ জীবন কাটাচ্ছি ঢাকা শহরের বাসায়। রোজ বিকেলে দুজনে ছাদে গিয়ে ছাদবাগানের ফুল-ফল গাছে পানি দিয়ে বসে থাকি চুপচাপ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দু-পাঁচটি করে প্রায় ৪৫টি নিশিবক উড়ে যায় দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। ওরা ওড়ে কবিতার ছন্দের মতো, ডাকতে ডাকতে চলে যায় আমাদের মাথার ওপর দিয়ে, ভোররাতে ঘরে শুয়ে ওদের নীড়ে ফেরার শান্তি-স্বস্তি ও আনন্দের ডাকও শুনি। আহ্ শান্তি! নিশাচর নিশিবক নিয়ে তাই অতীতের অনেক কথাই মনে পড়ে যায়!

নিশিবকেরা দল বেঁধে নিরিবিলি গাছে দিন কাটায়। ওই গাছেই কলোনি বাসা করে। সরু ডালপালা-বাঁশের কঞ্চি-পাটকাঠির টুকরো ইত্যাদি দিয়ে দাঁড়কাক-চিলের মতো বড়সড় বাসা বানিয়ে তাতে ডিম পাড়ে তিন থেকে পাঁচটি। ডিম ফুটে ছানা হয় ২০ থেকে ২৩ দিনে। ছানারা একটু বড় হলে মা-বাবার মুখ থেকে আগে খাবার নেওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে রক্তাক্ত লড়াইও করে। ভীষণ দুষ্টু ছানারা এ সময় তো বটেই, অন্য সময়েও ঠেলাঠেলি করে বাসা থেকে পড়ে যায়। এই ছানা ও ডিমের লোভে গাছে ওঠে গাছখাটাশ-গুইসাপ-দাঁড়াশ সাপ ও বনবিড়াল। তবে দিনের বেলায়ও ছানারা ওই প্রাণীগুলোকে শক্ত ঠোঁটে ঠোকর দেয়, বড় পাখিরাও শত্রুকে ঘিরে ধরে মহা কোলাহল কলরব করে, ঠোকর মারে। এমনিতেও ঠোকর দেওয়ার প্রবণতা এদের প্রবল। নিশাচর গাছখাটাশের পিচ্চি ছানাদের দুচোখ অন্ধ করে দিতে আমি দেখেছি, দেখেছি অর্ধমৃত দাঁড়াশ সাপ। বেজিরা নিয়মিত টহল দেয় এদের কলোনির তলায়। বিমুখ হয় না। রাতে টহল দেয় খাটাশ-শিয়াল। প্যাঁচারাও হানা দেয়।

নিশিবকের মূল খাবার মাছ-ব্যাঙ-ঘাসফড়িং-সদ্য ডিম ফুটে বেরোনো কচ্ছপের বাচ্চা-কুঁচে-কাঁকড়ার বাচ্চা-আপেল শামুকের ডিম ইত্যাদি। এককালে পাতানো বড়শিতে মাছ-ব্যাঙ গেঁথে নিশিবক শিকার করা হতো। নিশিবকেরা প্রবল ঝড়-বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টিতে খুবই অসহায় হয়ে পড়ে। দিন বা রাতে এ সময় ওরা গাছতলায় নেমে দাঁড়ায়। নষ্ট হয় ডিম-ছানা। পড়ে নানান প্রকারের শত্রুর কবলে। ইদানীং ওদের বিপদের মাত্রা বেড়েছে। ফসলের খেত ইঁদুরের কবল থেকে রক্ষা করতে সারা দেশেই খেত বিদ্যুতায়িত করে রাখা হয়, পেশাদার-নেশাদার শিকারিরা নানা ধরনের জাল-ফাঁদ পেতে রাখে হাওর-জলাশয়ে, খাল-বিলে। বন্দুক–এয়ারগান তো আছেই।

ছাদে বসে পাখিদের কত স্মৃতিই না মনে পড়ে আজ! নিশিবকের ইংরেজি নাম Black-Crowned night heron. বৈজ্ঞানিক নাম Nycticorax nycticorax. দৈর্ঘ্য ৫৮ থেকে ৬৬ সেন্টিমিটার। ওজন ৫০০-৮০০ গ্রাম। মাথার তালু-ঘাড় চকচকে নীলচে কালো, বুক-ঘাড়-চিবুক সাদা, পিঠ কালো, ডানার উপরিভাগ ছাই-ধূসর, কালচে ঠোঁট, হলুদাভ পা। ঘাড় খাটো এদের। ওয়াক, রাতচরা, শরত পাখি ও বিল বাচকো নামেও পরিচিত। কিশোর বয়সী বাচ্চাদের রং হয় লালচে-বাদামি, সারা শরীরে থাকে সাদা সাদা ছিট ছোপ। মাথার তালু গাঢ় বাদামি।