প্রজাপতি বাজ

রাজশাহী শহরের সিমলা পার্কে উড়ন্ত অবস্থায় প্রজাপতি বাজছবি: লেখক

রাজশাহীর পদ্মাসংলগ্ন সিমলা পার্কে সকালের মিষ্টি রোদে অদ্ভুতদর্শন খরমা পাখির ছবি তোলা শেষ করে দাঁড়িয়েছি মাত্র। এমন সময় মাথার ওপর দিয়ে একটি পাখি উড়ে গেল। পক্ষী আলোকচিত্রী শোভন আহমাদুজ্জামান ও মো. ইমরুল কায়েসকে নিয়ে ওর পিছু পিছু গেলাম। পাখিটি উড়ে গিয়ে মাঠের মধ্যে রাখা খড়ের স্তূপের ওপর বসল। সাক্ষী ছবি তুলে দ্রুত ওর কাছাকাছি গেলাম। বেশ কিছু ভালো ছবি তোলার পর খানিকটা সামনে এগোলাম। এবার পাখি ও আমাদের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে। কারণ, পাখিটি ইতিমধ্যে তার দেহ টান টান করে ফেলেছে। এর অর্থ, ওর ওড়ার সময় হয়ে গেছে। ক্যামেরা হাতে তিনজনই সতর্ক হয়ে দাঁড়ালাম।

পাখিটি ওর পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াল ও ডানায় শক্তি জড়ো করল। এরপর ভালোভাবে দম নিল, যাতে ওর ফাঁপা হাড়ের ভেতর থাকা ফুসফুসের বায়ুথলিগুলো বায়ু দিয়ে পূর্ণ হয়। এতে তার দেহ বেশ হালকা লাগবে ও স্বচ্ছন্দে উড়তে পারবে। সর্বশেষ সে মলত্যাগ করে দেহ আরও হালকা করে নিল। উড়তে আর এক সেকেন্ডও বাকি নেই। অবশেষে পাখিটি উড়ল। তার ওড়ার ঢং অনেকটাই যেন প্রজাপতির মতো, বেশ ধীরে ওড়ে। পুরোটা জমি এক চক্কর দিয়ে মাঠের কিছুটা দূরের একটা খুঁটির ওপর গিয়ে বসল। আর আমাদের দিয়ে গেল ওর প্রতিটি পদক্ষেপের ঝকঝকে ছবি।

এটি এ দেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি প্রজাপতি বাজ বা ইঁদুরমারা চিল। পশ্চিমবঙ্গে চুহামারা নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম লং-লেগড বাজার্ড বা বুটিও। গোত্র-Accipitridae, বৈজ্ঞানিক নাম Buteo rufinus। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার আবাসিক পাখিটি শীতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় পরিযায়ী হয়। ভবঘুরে হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও দেখা যায়।

প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতি বাজের দৈর্ঘ্য ৪৩-৫৮ সেন্টিমিটার (সেমি) ও প্রসারিত ডানা ১০৫-১৫৫ সেমি। ওজনে পুরুষ ৫৯০-১,২৮১ ও স্ত্রী ৯৪৫-১,৭৬০ গ্রাম। দেহের ওপরটা বাদামি। মাথা ও বুকের ওপরটা হালকা বাদামি। বুকের নিচ ও পেট লালচে-বাদামি। উড়ন্ত অবস্থায় ডানার প্রান্ত-পালকের সাদা গোড়া, ডানার নিচের দিকে প্রশস্ত কালো প্রান্তীয় পাড় ও কবজিতে সুস্পষ্ট কালো পট্টি চোখে পড়ে। ডানার ওপরে থাকে ফ্যাকাশে পট্টি ও লেজের ওপরে ডোরাবিহীন ফ্যাকাশে কমলা পালক। চোখ সোনালি-হলুদ। কালো চঞ্চুর গোড়া হলদে। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল হলুদ। নখ কালো। স্ত্রী-পুরুষে কোনো পার্থক্য নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ কম লালচে ও লেজে হালকা ডোরা থাকে। বড় আকার, লম্বা গলা ও লালচে পেটের মাধ্যমে সহজেই জাপানি বাজ থেকে ওদের পৃথক করা যায়।

শীতে ওরা দেশের প্রায় সর্বত্র, বিশেষ করে বড় নদী বরাবর উন্মুক্ত এলাকায়, একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। প্রজাপতির মতো দুর্বলভাবে ‘ভি’ আকারে ডানা মেলে আকাশের উঁচুতে উড়ে বেড়ায়। আকাশে ওড়া বা কোথাও বসা অবস্থা থেকে ইঁদুর, সাপ (এমনকি মারাত্মক বিষাক্ত শঙ্খচূড় বা রাসেলস ভাইপারকেও ছাড় দেয় না), সরীসৃপ বা বড় কীটপতঙ্গ ছোঁ মেরে ধরে খায়। সচরাচর নীরব, তবে প্রজননকালে ‘গিয়াররররর’ বা বিড়ালের মতো ‘মিউ-উ’ শব্দে ডাকে।

মার্চ থেকে মে প্রজননকাল। এ সময় মূল আবাস এলাকার পাহাড়ের চূড়া, ঢাল কিংবা উন্মুক্ত এলাকার প্রান্তে কোনো গাছে বড় ডালপালা, কাঠিকুটি ও পাতা দিয়ে মাচানের মতো বাসা বানায়। অন্য প্রজাতির পাখির পরিত্যক্ত বাসা মেরামত করেও ব্যবহার করতে পারে। স্ত্রী ডিম পাড়ে ২-৩টি, রং ধূসরাভ সাদা থেকে পীতাভ। সচরাচর স্ত্রীই ডিমে তা দেয়; পুরুষ ডিমে তা দানরত স্ত্রীকে খাবার সরবরাহ করে। ডিম ফোটে ৩৩-৩৫ দিনে। ছানারা ৪৩-৪৫ দিনে উড়তে শিখে ও বাসা ছাড়ে। আয়ুষ্কাল ৯-১০ বছর।