পাহাড়ি শিলাকচ্ছপের একেকটির ওজন গড়ে ৩৫ কেজি। আকৃতি ও ওজনের দিক থেকে বিশ্বে এদের অবস্থান ষষ্ঠ। প্রজাতি হিসেবে এরা ডাইনোসরের সমসাময়িক। প্রায় ৩০ কোটি বছর ধরে টিকে থেকে বিলুপ্তির কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। এই দুর্লভ পাহাড়ি শিলাকচ্ছপের প্রজাতিটিকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ সাফল্য পেয়েছেন বাংলাদেশের এক দল বন্য প্রাণী গবেষক। তাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কচ্ছপটিকে সংগ্রহ করে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে কৃত্রিম প্রজনন করেছেন। গত ডিসেম্বরে এদের ১০টিকে আবারও বান্দরবানের মাতামুহুরী বনভূমিতে ছেড়ে দিয়েছেন।
প্রায় ছয় মাস ধরে ওই গবেষকেরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, একটি বাদে বাকি ৯টি কচ্ছপ এখনো প্রকৃতিতে টিকে আছে। বনের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে তারা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। পাহাড়ে যারা এসব কচ্ছপ শিকার করে খেত, তাদের যুক্ত করে সেগুলোকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশ্বজুড়ে মহাবিপন্ন প্রজাতির ওই কচ্ছপদের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে আবারও বনের প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা এটাই বিশ্বে প্রথম। এর আগে মিয়ানমার ও ভারত বিশাল আকৃতির কচ্ছপগুলোর কৃত্রিম প্রজনন করলেও এখনো তারা এদের প্রকৃতিতে ছাড়তে পারেনি।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বন বিভাগ, কচ্ছপ সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা টার্টেল সারভাইভাল অ্যালায়েন্স ও বান্দরবান জেলা পরিষদ যৌথভাবে এই উদ্যোগ নিয়েছে। পাহাড়ি শিলাকচ্ছপ ৮০ থেকে ১০০ বছর বাঁচে। এদের আয়তন ৬১ সেন্টিমিটার।
এ ব্যাপারে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের প্রধান শাহরিয়ার সিজার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে আরও ২০টি পাহাড়ি শিলাকচ্ছপ বড় হচ্ছে। এ ধরনের কচ্ছপের জন্য প্রয়োজনীয় উঁচু–নিচু পাহাড় ও ঝরনা আছে এমন কয়েকটি এলাকায় আমরা এগুলোকে ছেড়ে দেব। স্থানীয় জনগণ, বন বিভাগ এবং দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যৌথভাবে কাজ করে এ ধরনের মহাবিপন্ন প্রাণীদের কীভাবে রক্ষা করা যায়, এই উদ্যোগ তার একটি বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে।’
গবেষক দলটি সূত্রে জানা গেছে, মাতামুহুরী বনের ২০০ একর এলাকা ওই শিলাকচ্ছপগুলোর বিচরণের জন্য নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। সেখানে তাদের খাবার, নিরাপত্তা ও বিচরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রথম কয়েক মাস তাদের সেখানে একটি বড় খাঁচায় রেখে ওই পরিবেশে অভ্যস্ত করা হয়। পরে বনের মধ্যে উন্মুক্ত জায়গায় ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে গবেষণার প্রয়োজনে এবং নিরাপত্তা ও বিচরণ পর্যবেক্ষণের জন্য এদের গায়ে বিশেষ ধরনের একটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে, যা থেকে গবেষক দলটি বুঝতে পারে সেগুলো কেমন আছে, কোথায় আছে।
গবেষক দলটি সম্প্রতি একটি শিলাকচ্ছপকে মৃত ও ওলটানো অবস্থায় বনের মধ্যে খুঁজে পায়। ধারণা করা হচ্ছে, চোরা শিকারিরা কচ্ছপটিকে ধরে নেওয়ার জন্য প্রথমে উল্টে দিয়ে ধরে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৮ প্রজাতির কচ্ছপ আছে। এর মধ্যে স্বাদুপানিতে থাকে ২৫ প্রজাতি ও সমুদ্রে তিন প্রজাতি। এদের বেশির ভাগই বিপন্ন ও মহাবিপন্ন তালিকায় চলে গেছে। বন বিভাগ প্রায়ই অভিযান চালিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিক্রির সময় সন্ধি কচ্ছপ ও কড়িকাইট্টা কচ্ছপ উদ্ধার করে থাকে। এই দুটি প্রজাতি বাংলাদেশে এক যুগ আগেও ব্যাপকভাবে দেখা যেত। কিন্তু বসতি নষ্ট হওয়া ও শিকারের কারণে এই দুটি প্রজাতিও বিপন্ন তালিকায় ঢুকে পড়েছে।