হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ
শুরুতে ঢিলেমি, শেষে তাড়াহুড়ায় দুর্বল কাজ
নভেম্বর মাসের মধ্যে সব প্রকল্প নির্ধারণ এবং পিআইসি গঠনের কথা। কিন্তু জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে এসেও প্রকল্প নেওয়া হয়।
সুনামগঞ্জে ২০১৭ সালের পর হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারকাজের পুরোটাই হচ্ছে স্থানীয়ভাবে গঠিত কৃষক ও সুবিধাভোগীদের নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে। তবে কোনো বছরই কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। কাজের শুরুতে ঢিলেমি থাকে, শেষ দিকে এসে তাড়াহুড়ায় কাজ হয় দুর্বল। তাই এসব বাঁধে পাহাড়ি ঢলের চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে ঝুঁকিতে পড়ে হাওরে কৃষকের কষ্টে ফলানো বোরো ফসল। সুনামগঞ্জে এবারও তা-ই হয়েছে।
হাওরে বাঁধ নির্মাণের নীতিমালা অনুযায়ী, নভেম্বর মাসের মধ্যে সব প্রকল্প নির্ধারণ এবং পিআইসি গঠনের কথা। এরপর ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু হয়ে শেষ হওয়ার কথা ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। মাঝে সময় হলো ৭৫ দিন। কিন্তু দেখা গেছে, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে এসেও প্রকল্প নেওয়া হয়।
এবার হাওরে বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে সুনামগঞ্জ পাউবো থেকে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুরুতে কাজে গতি ছিল কম। তখন প্রকল্প আর পিআইসি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন সবাই। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে যখন নানাভাবে দ্রুত কাজ শেষের দাবি ওঠে, তখন কাজে কিছুটা গতি আসে।
বাঁধের কাজ নীতিমালা অনুযায়ী হয়ে থাকে। আমাদের সঙ্গে প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ কাজ তদারকি করেন। কোথাও কোনো অভিযোগ পেলে সেটির ব্যবস্থা নেওয়া হয়সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী
পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, এবার ১৫ ডিসেম্বর জেলার ১১টি উপজেলায় মাত্র ১৮টি প্রকল্পে বাঁধের কাজ শুরু হয়। ওই দিন প্রকল্প অনুমোদন হয় ২৪৭টি। এর এক মাস পর ১৫ জানুয়ারি অনুমোদিত প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০১ এবং এর মধ্যে কাজ চলছিল ১৮৩টি প্রকল্পে। তখনো ৫০১টি প্রকল্পে কাজ শুরু হয়নি। গঠিত হয়নি ৩৩ পিআইসি।
এরপর ৩০ জানুয়ারি পাউবো জানায়, প্রকল্প বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২০টি, কাজ চলছে ৬০২টিতে। তখনো ১১৮টি প্রকল্পে কাজ শুরুই হয়নি। অথচ কাজের সময় ছিল মাত্র ২৮ দিন। তখনো কোনো উপজেলাতেই কাজের অগ্রগতি ৫০ শতাংশের বেশি ছিল না। সর্বনিম্ন ছিল শাল্লায় ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ছিল সদর উপজেলায় ৪১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
হিসাব করে দেখা গেছে, যে উপজেলায় ৪৭ দিনে কাজের অগ্রগতি ছিল মাত্র ৭ শতাংশ, সেখানে বাকি ২৮ দিনে সেটা দাঁড়িয়েছে ৯৫ শতাংশ। যে উপজেলার অগ্রগতি ছিল ৫ শতাংশ, সেটা হয়েছে ৯৬ শতাংশের ওপরে। মূলত শেষ দিকে কাজের ‘শেষ’ দেখাতে জেলার সব হাওরে পিআইসিদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যায়।
গত মঙ্গলবার দুপুরে জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরের রাধানগর এলাকার একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে গিয়ে দেখা গেছে, ওই বাঁধের গোড়া থেকে মাটি তুলে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এখন সেখানটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাঁধের নিচ দিয়ে ছিদ্র হয়ে পানি ঢুকছে হাওরে।
স্থানীয় কৃষক, হাওর আন্দোলনের নেতা, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাঁধের কাজে নানা পর্যায়ে অনিয়ম ও গাফিলতি হয়ে থাকে। প্রকল্প নির্ধারণ ও পিআইসি গঠনে বিলম্ব, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ, সময়মতো কাজ শুরু না হওয়া, শুরুতে কম গতি, তদারকির অভাব, হাওর থেকে পানি ধীরে নামা, মাটির অভাবসহ বিভিন্ন কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু ও শেষ করা যায় না। প্রতিবছরই কাজের সময় বাড়ানো হয়। এবারও বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু কাজ আর শেষ হয়নি।
দেখা গেছে, গত বছরের কাজের বকেয়া ২০ কোটি টাকার বিল এ বছর দেওয়া হয়েছে। এবার কাজে গাফিলতির অন্যতম একটা কারণ হিসেবে স্থানীয় লোকজন বলছেন, গত চার বছর হাওরে অকাল বন্যা হয়নি। কৃষকেরা নির্বিঘ্নে ফসল গোলায় তুলেছেন। তাই বাঁধের কাজে থাকা লোকজনের ধারণা ছিল এবারও অকাল বন্যা হবে না। যে কারণে কাজে গাফিলতি ছিল বেশি। একইভাবে প্রয়োজনীয় তদারকিরও অভাব ছিল।
গত মঙ্গলবার দুপুরে জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরের রাধানগর এলাকার একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে গিয়ে দেখা গেছে, ওই বাঁধের গোড়া থেকে মাটি তুলে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এখন সেখানটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাঁধের নিচ দিয়ে ছিদ্র হয়ে পানি ঢুকছে হাওরে। বাঁধে যে অংশে বাঁশ, বস্তা দিয়ে আড় দেওয়ার কথা, সেটি করা হয়নি। কথা বলার জন্য ওই পিআইসির সভাপতি সাজিদুর রহমানকে সেখানে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা গোলাম রব্বানী (৫৮) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কাজ তো হয়েছে দায়সারাভাবে। আগে কেউ খোঁজ নেয়নি। এখন ঢল আসছে, সবার দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলা মাটিয়ান হাওরের তেমনি একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ছিলান তাহিরপুর এলাকার। এটির কাজ শুরু হয়েছে নির্ধারিত সময়ের এক মাস পর। প্রকল্পের সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, তাঁর ২২ লাখ টাকার কাজে বিল দেওয়া হয়েছে ১৩ লাখ টাকা। টাকার অভাবেও কাজে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় প্রথম আলোকে বলেন, কাজে অনিয়ম-দুর্নীতিই বড় সমস্যা। কঠোর তদারকি নেই। পিআইসিরা টাকা পেতে হয়রানির শিকার হয়। আবার কোনো পিআইসিতে বেনামে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক দলের লোকজন যুক্ত। তাঁরা দায়সারাভাবে কাজ করেন। তবে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটা যোগসাজশ থাকে।
পাউবো সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জে এবার ৭২৭টি প্রকল্পে বাঁধের কাজ হয়েছে। এসব কাজে প্রাক্কলন ধরা আছে ১২১ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৬৬ কোটি টাকা।
সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘বাঁধের কাজ নীতিমালা অনুযায়ী হয়ে থাকে। আমাদের সঙ্গে প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ কাজ তদারকি করেন। কোথাও কোনো অভিযোগ পেলে সেটির ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, হাওরের পরিবেশ-প্রকৃতি আলাদা। এখানে ইচ্ছে করলেই সবকিছু সময় বেঁধে করা যায় না। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাঁধ নির্মাণের মতো একটি বিশাল কাজ কম সময়ের মধ্যে হয়ে থাকে। এতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতেই পারে।