বনসেতু দিয়ে পার হচ্ছে বন্য প্রাণী। সম্প্রতি সাতছড়ির বনসেতুতে
ছবি: সংগৃহীত

লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতরের সড়কের ওপর দিয়ে বন্য প্রাণীর নিরাপদ পারাপারের জন্য তৈরি করা হয়েছে বনসেতু বা ক্যানোপি। হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ২০২০ সালের নভেম্বরে নির্মাণ করা হয় দেশের প্রথম বনসেতু। শুরুতে তিনটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে আরও তিনটি করা হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে লাউয়াছড়ায় তৈরি করা হয় আরও পাঁচটি বনসেতু। এর মধ্যে সাতছড়িতে বানরজাতীয় প্রাণীসহ হাজারের বেশি বন্য প্রাণীর এই সেতু ব্যবহারের তথ্য মিলেছে।

কিন্তু ক্যামেরা–বিভ্রাটের কারণে লাউয়াছড়ায় বন্য প্রাণীর সেতু ব্যবহারের তথ্য রেকর্ড হয়নি। বন্য প্রাণী গবেষকদের দাবি, সাতছড়িতে বনসেতু নির্মাণের লক্ষ্য প্রায় সফল। তবে লাউয়াছড়ায় ফলাফল জানতে নতুন ক্যামেরা স্থাপন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ সেতু তৈরির ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় বন্য প্রাণীর মৃত্যু কমেছে।

নাইলনের মোটা রশি সড়ক ও রেলপথের দুই পাশের দুটি উঁচু গাছের ডালপালার মধ্যে বেঁধে সংযোগ স্থাপন করে এই সেতু তৈরি করা হয়েছে। সেতুগুলোর দূরত্ব ২২ থেকে ২৫ মিটার। সেতুগুলো দিয়ে দিনে কয়টি উল্লুকসহ অন্যান্য প্রাণী পারাপার হয়, তা জানতে স্থাপন করা হয় ক্যামেরা।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং গবেষক দল সূত্রে জানা গেছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরে ঢাকা-সিলেট রেললাইন এবং শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কের বিভিন্ন স্থান অনেক প্রশস্ত। অনেক প্রাণীর পক্ষে এক পাশের গাছ থেকে আরেক পাশের গাছে লাফ দিয়ে পারাপার সম্ভব হয় না। কিছু প্রাণী সড়ক ও রেলপথ দিয়ে পার হয়। বছরে শতাধিক বন্য প্রাণী সড়ক পার হতে গিয়ে মারা পড়ে। গত শুক্রবারও সেখানে একটি বানরের মৃত্যু হয়।

লাউয়াছড়ায় সড়কপথের দুই পাশে বন্য প্রাণী পারাপারের সুবিধার্থে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল যৌথভাবে পাঁচটি বনসেতু নির্মাণ করে।

লাউয়াছড়া সেতু স্থাপনের কাজটিতে ছয় সদস্যবিশিষ্ট গবেষক দলের নেতৃত্ব দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুন নাহার। তিনি বলেন, ‘দুর্বল ক্যামেরার কারণে ভালো ছবি আসেনি। ক্যামেরাটি প্রাণী আলাদা করতে পারে না। আমরা বন বিভাগের কাছে উন্নত মানের ক্যামেরা চেয়েছি। নতুন ক্যামেরা স্থাপনের পর ছয় মাস পর্যবেক্ষণ করব।’

অন্যদিকে সাতছড়িতে বনসেতু নির্মাণের আগে সড়ক পারাপারের সময় দুর্ঘটনায় বছরে ১২টি পর্যন্ত বানরজাতীয় প্রাণীর মৃত্যুর তথ্য আছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, সেতু স্থাপনের পর এখন পর্যন্ত দুর্ঘটনায় বানরজাতীয় কোনো প্রাণীর মৃত্যু হয়নি। সাতছড়িতে সাত প্রজাতির বানরজাতীয় প্রাণী আছে। এর মধ্যে উল্লুক ও আসামিজ বানর ছাড়া বাকি সব কটি প্রজাতির বানর বনসেতু দিয়ে আসা-যাওয়া করেছে। এ ছাড়া গন্ধগোকুল, কাঠবিড়ালিসহ হাজারের বেশি প্রাণী সেতু পার হয়েছে।

সাতছড়ি বনসেতু কার্যক্রমের তত্ত্বাবধায়ক বন্য প্রাণী গবেষক মো. হাসান আল রাজী প্রথম আলোকে বলেন, ‘লক্ষ্য ও রেকর্ড অনুযায়ী সাতছড়িতে বনসেতু ৯০ শতাংশ সফল। সেতু স্থাপনের পর দুর্ঘটনায় কোনো বানরজাতীয় প্রাণী মারা যায়নি।’

সাতছড়িতে বনসেতু প্রকল্পের প্রধান গবেষক মারজান মারিয়া বলেন, ‘সাতছড়িতে সেতু প্রায় সফল। যে রকম ফল চেয়েছিলাম, সে রকম পেয়েছি। এখন এ সেতু দিয়ে বানর, হনুমান চলাচল করছে।’

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘লাউয়াছড়ায় নতুন উন্নত মানের লেজার বিম ক্যামেরা শিগগিরই স্থাপন করা হবে।’

গবেষক দল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪০ থেকে ৪১টি উল্লুক আছে। পরিবার আছে ১৩টি। আর ২০১৮ সালের জরিপে দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চলের লাউয়াছড়া, আদমপুর, সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গাসহ দেশের ২২টি স্থানে ৪০০টি উল্লুক আছে।