সাতছড়ির বিরল হরিয়াল

হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের একটি গাছে তিনটি পুরুষ হরিয়াল। গত ৯ মার্চ ভোরে
ছবি: লেখক

প্রথমবার ধূসরডানা কালো দামার (গ্রে-উইংড ব্ল্যাকবার্ড) ছবি তুলি ভারতের দার্জিলিংয়ে—২০১৬ সালে। ঠিক এক বছর পর ওদের দেখলাম নৈনিতালে। তবে এ দেশে কখনো দেখিনি। কারণ, পরিযায়ী পাখিগুলো এখানে অনিয়মিত। এ বছর মার্চের শুরুতে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ওদের একটিকে দেখা গেল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা থাকায় সঙ্গে সঙ্গে যেতে পারলাম না। ৮ মার্চ ফজরের আজানের আগেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে সাতছড়ির টাওয়ারে উঠে অবস্থান নিলাম। কিন্তু পরপর দুই দিন চেষ্টা করেও পাখিটির দেখা পেলাম না। তাহলে কি বিরল পরিযায়ী পাখিটি চলে গেল? আবার কবে আসবে, কে জানে?

মান্দারগাছের কণ্টকময় ডালের ওপর ফুটে থাকা টকটকে লাল ফুলগুলোর দিকে আনমনে চেয়ে আছি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শামীম হাসান ভাইয়ের ডাকে আনমনা ভাব কাটল। তিনি টাওয়ার থেকে খানিকটা দূরে একটি গাছে বসা বুনো কবুতরগুলোর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন। ‘বটকলের (ইয়েলোফুটেড গ্রিন পিজিয়ন) পাশে বসা পাখিগুলো কি চঞ্চুমোটা হরিয়াল (থিক-বিল্ড গ্রিন পিজিয়ন)?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে তাঁর নির্দেশিত বুনো কবুতরগুলোকে ফোকাস করলাম। ‘না, এগুলো তো চঞ্চুমোটা হরিয়াল বা হরিকল নয়, বরং তার চেয়েও বিরল কবুতর!’ আমি বললাম।

সঙ্গে সঙ্গে টাওয়ারের অন্য আলোকচিত্রীরাও ওদের দিকে ক্যামেরা তাক করলেন। ঠিক তিন বছর আগে ওদের একটিকে এখানেই দেখেছিলাম, বেশ দূর থেকে। ভোর ৬টা ৩৫ থেকে ৭টা পর্যন্ত ওরা ওখানে ছিল। কাজেই ধীরেসুস্থে কিছু ভালো ছবি তোলা গেল।
বুনো কবুতরের প্রতি সব সময়ই আমার আকর্ষণ একটু বেশি। ওদের পালকের রং অত্যন্ত সুন্দর। মাথা, ঘাড় ও পেট হলদেটে সবুজ। মাথার চাঁদি ও বুকে রয়েছে কমলার আভা। ঘাড়ের পেছনটা ধূসর, পিঠ গাঢ় সবুজ ও ডানার শেষ প্রান্ত কালো। পায়রার কাঁধ ও ডানার পালক মেরুন, তবে পায়রীর ক্ষেত্রে তা সবুজ। জলপাইরঙা লেজটি প্রথমে মোটা, এরপর ধীরে ধীরে ধারালো হয়ে লেজ বরাবর চওড়া হয়ে গেছে। চোখের রং নীল। চঞ্চু ছাই রঙের, যার গোড়া নীল। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল লাল। কবুতরগুলোর দেহের দৈর্ঘ্য ৩০ থেকে ৩৩ সেন্টিমিটার ও ওজন ২০৫-২১৪ গ্রাম।

এরা সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড় ও টিলাময় মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে ফলদ গাছে বিচরণ করে। ডালের শেষ প্রান্তে ফলের কাঁদিতে ঝুলে থেকে ফল খায়। বট, পাকুড়, জগডুমুর ও অন্যান্য রসাল ছোট ফল পছন্দ করে। মাটি থেকে লবণ নেওয়া ও পানি পান করা ছাড়া সচরাচর নিচে নামে না। অত্যন্ত দ্রুত ডানা ঝাপটে তরঙ্গায়িত হয়ে ওড়ে। প্রজননকালে মোলায়েম কণ্ঠে ঘুঘুর মতো ‘হুও...হুউ...হুহুহু...হুও...হুউ...হুহুহু...’ স্বরে ডাকে।

এপ্রিল থেকে জুন প্রজননকাল। এ সময় পত্রবহুল কচি গাছে পাতা দিয়ে হালকা ধরনের বাসা গড়ে। পায়রী দুটি সাদা রঙের ডিম পাড়ে, যা ১৮-১৯ দিনে ফোটে। আয়ুষ্কাল চার থেকে পাঁচ বছর।

সাতছড়িতে দেখা বিরল বুনো কবুতরগুলো এ দেশের আবাসিক পাখি। নাম হরিয়াল। পশ্চিমবঙ্গে বলে কীলক হরিয়াল। ইংরেজি নাম ওয়েজ-টেইল্ড গ্রিন পিজিয়ন বা ককলা গ্রিন পিজিয়ন। গোত্র কোলাম্বিডি। বৈজ্ঞানিক নাম Treron sphenurus। বাংলাদেশ ছাড়াও হিমালয়ের পাদদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পার্বত্যাঞ্চল থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ওরা বিস্তৃত।

আ ন ম আমিনুর রহমান, অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর