একবার তীব্র খরার কবলে পড়ে অঞ্চলটি। পানির অভাবে চাষবাস করতে পারছেন না কৃষক। সেই অঞ্চলের রাজা ছিলেন প্রজাদরদি। প্রজার ভালো–মন্দ নিয়ে ছিল তাঁর চিন্তাভাবনা। খরার প্রকোপ থেকে কৃষকদের সুরক্ষা দিতে সেই রাজা খনন করলেন বিশাল এক দিঘি। কিন্তু সেই দিঘিতে পানি ওঠে না। পানি যখন উঠল, রাজা হারালেন রানিকে। এটা প্রায় ৪০০ বছর আগের ঘটনা। এখনো দিঘিটি আছে, সঙ্গে টিকে আছে সেই জনশ্রুতিও।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আলীনগর ইউনিয়নের মঙ্গলপুর গ্রামে অবস্থান দিঘিটির। তখন এই অঞ্চলের রাজা ছিলেন হরিনারায়ণ রায়। তাঁর নামেই নাম ‘হরিনারায়ণ দিঘি’। এই দিঘির পাশেই কোথাও ছিল রাজার প্রাসাদ। এখন যদিও সেই প্রাসাদের চিহ্ন আর চোখে পড়ে না। তবে এই প্রাচীন দিঘিটি যুগ যুগ ধরে স্থানীয়দের পানির চাহিদা মিটিয়ে চলছে। শীতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে পরিযায়ী পাখি। বারো মাসই আসেন পর্যটক। দিঘির পাড়ে গাছের ছায়ায় বসে কেউ কেউ সময় পার করেন। দিঘির সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
স্থানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৮০ থেকে ১৬০০ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে রাজা হরিনারায়ণ রায় তাঁর রাজমন্দিরের সামনে বিশাল এই দিঘি খনন করেছিলেন। দিঘিটির আয়তন প্রায় ১২ বিঘা (৩৬০ শতক)।
দিঘি খননের জনশ্রুতি ও ইতিহাসের সূত্র ধরে মঙ্গলপুর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি চন্দ্রমোহন পণ্ডিত জানিয়েছেন, এ অঞ্চল নিয়ে এক বিশাল রাজ্য ছিল রাজা হরিনারায়ণের। রাজা হরিনারায়ণ ছিলেন খুবই প্রজাবৎসল শাসক। প্রজাদের কিসে ভালো হয়, সব সময় এ চিন্তা করতেন। তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যে খরার প্রভাব দেখা দেয়। খরার প্রভাবে প্রজাদের ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল। খরার প্রভাব থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে মন্দিরের সামনে রাজা হরিনারায়ণ রায় প্রচুর জনবল দিয়ে বৃহৎ এ দিঘি খনন করেন। জনশ্রুতি হচ্ছে, দিঘি খননের বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও দিঘিতে পানি ওঠেনি। এতে রাজা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। দিঘিতে পানি ওঠার জন্য দিঘির ভেতরে একটি কূপ খনন করান। তারপরও পানি ওঠেনি। এরই মধ্যে রাজার ঘর আলো করে একমাত্র পুত্রসন্তান আসে। হঠাৎ এক রাতে রাজা স্বপ্ন দেখেন প্রিয় সহধর্মিণী ভানুমতী দিঘির মধ্যে খননকৃত কূপে শুদ্ধাচার দেহে এক কলসি পানি ঢাললে দিঘিতে পানি উঠবে। পরের দিনই রাজা হরিনারায়ণের আদেশমতো রানি ভানুমতী একটি মাটির কলসি ভরা পানি নিয়ে কূপে ঢালতেই কূপ থেকে গমগম করে পানি উঠতে শুরু করে। তবে রানি ভানুমতী সেখান থেকে আর উঠে আসতে পারেননি। দিঘিতেই ডুবে যান। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও রানিকে আর পাওয়া যায়নি।
দিঘিতে পানি উঠেছে ঠিকই। কিন্তু প্রিয় সহধর্মিণীকে হারিয়ে রাজা হরিনারায়ণ শোককাতর হয়ে পড়েন। রানির শোকে রাজ্যশাসনে রাজা আর মন দিতে পারেননি। ক্রমে রাজ্যের সবকিছু তাঁর হাতছাড়া হতে থাকে। কালক্রমে রাজার সব চিহ্ন হারিয়ে যায়। তবে সবকিছু নিশ্চিহ্ন হলেও দিঘিটি এখনো রাজার স্মৃতিচিহ্ন ধরে রেখেছে। এলাকার মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করে চলছে। দিঘির দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য ও শান্ত–নিবিড় পরিবেশ মানুষকে আকৃষ্ট করছে। এই দিঘি এখন কমলগঞ্জের পর্যটনশিল্পকেও সমৃদ্ধ করছে। দিঘিটির ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে রয়েছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসন থেকে বার্ষিক বন্দোবস্ত নিয়ে এ দিঘিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
হরিনারায়ণের দিঘিটি এখন কমলগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি অংশ। দিঘিটি দেখতে সেখানে প্রচুর পর্যটক যান। দিঘিটিকে তার নিজস্ব প্রকৃতিতে রেখেই সংরক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানালেন কমলগঞ্জের ইউএনও আশেকুল হক।