
মৌলভীবাজারের হাইল হাওরের বাইক্কা বিল। মাছের পাশাপাশি এখন পাখিদেরও অভয়াশ্রম। প্রতিদিন হাজার মাইল দূর থেকে এসে ভিড় করছে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। সকাল-সন্ধ্যা এই অতিথি ও স্থানীয় পাখির ওড়াউড়ি আর কলকাকলিতে মুখর বিলটি হয়ে উঠেছে পাখির এক রাজ্য।
শীতের শুরুতেই ঝাঁক বেঁধে বিলে আসা শুরু করেছে পরিযায়ী পাখিরা। বিলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত শুধু এদেরই অবাধ বিচরণ। ডানা ঝাপটানোর শব্দে চঞ্চলতায় ভরে উঠেছে নির্জন বিলের প্রান্তর। আকাশে মালা গাঁথছে ঝাঁকবাঁধা ছোট-বড় পাখি।
গত সপ্তাহে হাওরে গিয়ে দেখা যায়, শীত এখনো জমে ওঠেনি। তবে জমে উঠেছে পাখির মেলা। বিলের জল, কচুরিপানা ও পদ্মপাতায় হাজােরা পরিযায়ী পাখি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। দূর থেকে বোঝাই যায় না এই পাখিরাজ্যের অস্তিত্ব। তবে কিছু পর পর ঝাঁক বেঁধে উড়ে গিয়ে রাজ্যে নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিচ্ছে তারা। বিলের পাড়ে সৃজিত হিজলবনে সন্ধ্যাবেলা ডাকাডাকিতে তৈরি করছে বুনো পরিবেশ।
বিলের ব্যবস্থাপনায় থাকা কর্মীরা জানান, এখন পর্যন্ত বিলে আসা পরিযায়ী পাখির মধ্যে আছে পিয়ং হাঁস, গিরি হাঁস, খুন্তে হাঁস, বেলে হাঁস, কমন কুট, পাতি পান সরালি, গ্রে-হেরন (ধূসর বক), লালচে বক, দাগি রাজহাঁস, রাজ সরালি, পাতি সরালি, ফুলুরি হাঁস, লেনজা হাঁস, পলাশি ফিশ ইগল, কাঁকড়া কোকিল, বড় নল ফুটকি, ছোট নল ফুটকি, মেটে মাথা টিটি ইত্যাদি। এ ছাড়া দেশীয় পাখি বেগুনি কালেম, বক, শালিক, চিল ইত্যাদি আগে থেকে তো রয়েছেই।
ব্যবস্থাপক মিরাশ মিয়া জানান, সপ্তাহ দুই ধরে বিলটিতে আসতে শুরু করেছে পরিযায়ী পাখি। এ বছর বিরল প্রজাতির মধ্যে এখানে পাঁচটি দাগি রাজহাঁস দেখা গেছে। বিলে পাখি শিকারির উৎপাত নেই।
তবে বিলে আসা-যাওয়ার পথে ধানখেতে ও হাওরের বিভিন্ন স্থানে পাখি শিকার করতে জালের তৈরি ফাঁদ পেতে রাখতে দেখা গেছে। পাখিরা যখন এই বিল থেকে অন্যত্র খাবারের সন্ধানে উড়ে যাচ্ছে, তখন এসব ফাঁদে ধরা পড়ছে।
বাইক্কা বিল ব্যবস্থাপনার কাজে যুক্ত বেসরকারি সংগঠন ক্রেল-এর সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের হাইল হাওরে একসময় ১৭৫ প্রজাতির পাখি দেখা যেত। এর মধ্যে ৯৫টি প্রজাতিই ছিল প্রধানত জলচর। কিন্তু বিল সেঁচে মাছ ধরা, অবাধে পাখি মারা, জলজ উদ্ভিদ আহরণসহ নানা কারণে পাখি ও মাছের সংখ্যা কমে যায়। এই অবস্থায় পরিবেশ ফেরাতে ২০০৩ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় প্রায় ২৫০ একরের বাইক্কা বিলকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে।
পরে বিলে মাছ ধরা ও জলজ উদ্ভিদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। একপর্যায়ে বিলের পরিবেশ ফিরে এলে এবং তা নিরাপদ আশ্রয়ের মতো হয়ে ওঠায় পরিযায়ী পাখিরা আবারও আসা শুরু করে। আর বছরজুড়ে বাস শুরু করে বেগুনি কালেমসহ অনেক স্থানীয় পাখি।
গত বছর শীত মৌসুমে বিলে ৪২ প্রজাতির সাড়ে ১০ হাজারের মতো পাখি দেখা গেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তিনটি নখতা হাঁস (কম ডাক) ও ১৭টি কালো কাস্তেচরা (গ্লোসি আইবিস)। ওই বছর প্রায় প্রতিদিনই পাখি দেখতে বিলে ভিড় করেছেন দেশি-বিদেশি পর্যটক।
ক্রেলের কর্মী মনিরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, এবার শীতের শুরুতেই বিলে পাখি বেশি দেখা যাচ্ছে। শীত বাড়ার সঙ্গে পাখির সংখ্যাও বাড়বে। স্থানটিকে আমরা যদি নিরাপদ রাখতে পারি, তাহলে সারা বছরই পাখি থাকবে।