হারিয়ে যাওয়া এক বানর

টেকনাফের বনে প্যারাইল্লা বানর
ছবি: তারিক কবির

বুদ্ধিমান এক বানর প্রজাতি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেল। আর মাত্র একটি বানর কক্সবাজারের টেকনাফ বনাঞ্চলের কেরুনতলীতে টিকে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবশেষ বানরটিও হয়তো কিছুদিনের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ, তার কোনো সঙ্গীসাথি নেই। প্রজননের কোনো উপায়ও নেই। মাত্র এক প্রজন্মের ভেতর অতি দ্রুতই একটি বানর প্রজাতির বড় দল তার বুনো পরিবেশ থেকে হারিয়ে গেল। প্রাণিজগতের এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।

অচেনা এই বানর প্রজাতির নাম প্যারাইল্লা বানর। অনেকে এই বানরকে কাঁকড়াভুক বানর নামেও চেনেন। বানরটির ইংরেজি নাম লং টেইলড ম্যাকাক। বিশ্বাসই করতে পারছি না, বানরটি আমাদের বুনো পরিবেশে আর নেই। মনে হয় এই তো কদিন আগেই এর দেখা পেয়েছিলাম টেকনাফের প্যারাবনে। ২০০৯ সালে গিয়েছিলাম জলচর পাখি গণনায় টেকনাফের বোদরমোকামে। পাখি গণনা শেষে বানরটি দেখার আশায় গেলাম কেরুনতলী এলাকায়। একটি ছোট দলের দেখাও পেলাম। কিন্তু কোনোভাবেই ভাবতে পারছি না, এ দেশ থেকে বানরটি হারিয়ে গেল।

গবেষক বন্ধু তারিক কবির খুব আফসোস করে বললেন, হয়তো শেষ বানরটি মারা গেছে। তিনি দীর্ঘদিন থেকে বানরটির ওপর নজর রাখছিলেন। পুরো এলাকাটি তাঁর চেনা।

প্যারাইল্লা বানরের সংখ্যার ওপর একটি পরিষ্কার ধারণা গবেষকদের আছে। ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান বানর প্রজাতিটির ওপর প্রথম জরিপ চালান। সে সময় ২৫৩টি বানর ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। টেকনাফের যে অঞ্চলে বাদাবন ছিল, মূলত সে অঞ্চলেই এ বানর প্রজাতি দেখা যেত। এ সময়ের মধ্যে টেকনাফ অঞ্চলের বেশ কিছু প্যারাবন কেটে লবণ আর মাছ চাষের উপযোগী করা হয়। বানরগুলো তাদের প্রিয় আবাসস্থল হারিয়ে ফেলে।

দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাফা ফিরোজ চকরিয়ায় ১৩-১৭টি বানরের একটি দল খুঁজে পান। এরপর থেকে মূলত তারিক কবির তাঁর নিয়মিত জরিপকাজ চালিয়ে যান। তিনি বানরটির ওপর থ্রেটেন্ড ট্যাক্সা নামক একটি সাময়িকীতে একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধও প্রকাশ করেন। ২০০৯ সালে টেকনাফের নাফ নদী এলাকায় দুটি দলে মোট আটটি বানরের সন্ধান পাওয়ার তথ্য আছে। পরের বছর এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ছয়। সবশেষ ২০১২ সালের একটি জরিপে দেখা যায়, একটি দলে মাত্র তিনটি বানর আছে নাফ নদীর পাদদেশে। এরপর আরও পাঁচ বছর বানরের এই দল ওই এলাকায় দেখা গেছে। সবশেষে মাত্র একটি বানর দেখা গেছে টেকনাফের কেরুনখালীতে।

কোনো কোনো গবেষকের ধারণা, এই বানর চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী বনের রেসাস বানরের সঙ্গে সংকর প্রজনন হতে পারে। এ বিষয়ে ভালো গবেষণা হওয়া দরকার। সত্যিই যদি আমাদের কোনো হাইব্রিড বানর ফাঁসিয়াখালীতে থাকে, তাহলে তার প্রজনন বাড়িয়ে আবার তাকে পরিবেশে ফিরে আনা সম্ভব হতেও পারে। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের টেকনাফের জিনোমখালীর দূরত্ব খুব বেশি নয়। এই স্থানেও এ বানর প্রজাতির জন্য আবাসস্থল সৃষ্টি করে আমাদের বনে বানরটি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

প্যারাইল্লা বানর বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন একটি প্রাণী। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে এই প্রজাতির বানর রয়েছে। আর দশটি বানরের চেয়ে সত্যিই বুদ্ধিমান। বানরটি ভালো সাঁতারুও বটে। শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে তাদের সাঁতার কাটতে দেখা যায়। জলের ওপর উঁচু গাছে তারা ঘুমাতে পছন্দ করে।