খুলনায় চিকিৎসকদের কর্মবিরতি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই

চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা। গতকাল শুক্রবার সকালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

চিকিৎসাসেবা নিয়ে রোগী ও চিকিৎসকদের বক্তব্যে বিপরীতধর্মী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ অবস্থান সেবাগ্রহীতার ও সেবাদাতার। কোনো ধরনের উদ্যোগ না নেওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে রোগী ও চিকিৎসক যেন দুটি পক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। জনমনে এ ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে দুপক্ষের দূরত্ব বাড়ছে।

সমস্যাটি পুরোনো। এ সমস্যা কখনো সহিংসতায় রূপ নেয়। চিকিৎসকেরা ধর্মঘটে যান। চিকিৎসা বন্ধ থাকে। চরম ভোগান্তির শিকার হন রোগীরা। স্থানীয়ভাবে মিটমাট হয়। আজ খুলনায় যে সমস্যা, তা হয়তো আজ মিটে গেছে। তবে জাতীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ না নিলে কিছুদিনের মধ্যে অন্য কোনো জেলায় এ সমস্যা আবার দেখা দেবে।

‘ হাসপাতাল পরিচালনা করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী; স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বহুবার জানানো হয়েছে, হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের কর্মস্থলটা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এখানে অবকাঠামো নেই, এখানে জনবল নেই, এখানে চিকিৎসার উপকরণ নেই, রোগ নির্ণয়ের জন্য পর্যাপ্ত প্রযুক্তি নেই। এগুলো চিকিৎসাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে। তখন রোগীর স্বজনেরা ক্ষুব্ধ হন, তখন তাঁরা চিকিৎসককে পেটান। এ পিটুনি চিকিৎসকেরা কত বছর ধরে খাবেন?’
শেখ বাহারুল আলম, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) খুলনা জেলা শাখার সভাপতি
আরও পড়ুন
দূরদূরান্ত থেকে বহির্বিভাগের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। গত বুধবার সকালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধর্মঘট শুরু হয়। শনিবার চিকিৎসকদের কর্মবিরতি স্থগিতের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়
ছবি: প্রথম আলো

এটি হাসপাতালকেন্দ্রিক সমস্যা—রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যকার সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল, তা তারা নেয়নি। তারা সব সময় অ্যাডহক ভিত্তিতে সমাধান করতে চেয়েছে। সমস্যার মূল্যে যেতে চায়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যাদের সেবা দিতে চায় এবং যাদের মাধ্যমে সেবা দিতে চায়—এ দুই পক্ষের সম্পর্ক উন্নয়নে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে বলে শোনা যায়নি।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) খুলনা জেলা শাখার সভাপতি শেখ বাহারুল আলম খুলনার উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে যথার্থই বলেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা বুঝতে হবে, সরকারি হাসপাতালের মালিক হলো রাষ্ট্র। এ হাসপাতাল পরিচালনা করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী; স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বহুবার জানানো হয়েছে, হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের কর্মস্থলটা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এখানে অবকাঠামো নেই, এখানে জনবল নেই, এখানে চিকিৎসার উপকরণ নেই, রোগ নির্ণয়ের জন্য পর্যাপ্ত প্রযুক্তি নেই।

এগুলো চিকিৎসাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে। তখন রোগীর স্বজনেরা ক্ষুব্ধ হন, তখন তাঁরা চিকিৎসককে পেটান। এই পিটুনি চিকিৎসকেরা কত বছর ধরে খাবেন? এ কারণে চিকিৎসকেরা মনে করছেন, এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার। এ জন্য তাঁরা কর্মস্থল থেকে চলে এসেছেন।’

আরও পড়ুন
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

খুলনার শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে একজন চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে ও আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত বুধবার থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন খুলনার চিকিৎসকেরা। এটি মিটমাটের জন্য আলোচনা হয়েছে, সমাধান হয়নি।

এদিকে বুধবার সকাল থেকে গতকাল শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত তিন দিনে এ হাসপাতালে মারা গেছেন ৫৩ জন রোগী। এর মধ্যে বুধবার ১৭ জন, বৃহস্পতিবার ২০ জন ও গতকাল ১৬ জন মারা গেছেন। এ বিষয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মুমূর্ষু অবস্থায় অনেক রোগী আসেন। তাই হাসপাতালে ২০ থেকে ২২ জন রোগী প্রতিদিনই মারা যান। এটা হাসপাতালের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। চিকিৎসকের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছেন, ব্যাপারটি আসলে তা নয়।

কিন্তু বারবার কেন এমন হয়? সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের ঘটনাগুলো প্রায় নিয়মিত খবরে পরিণত হতে দেখা যাচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন সংবাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। ঘটনা ঘটলে মারামারি, ভাঙচুর, থানা-পুলিশ, মামলা, বদলি—এসবের মাধ্যমেই সমাধানের চেষ্টা চলে। সমাধান হয় না। কারণ, সমস্যার মূলে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় না।

চিকিৎসক-রোগীর পরস্পরের প্রতি মনোভাব

চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট বছর দুই আগে একটি গবেষণা করেছিল। চিকিৎসায় আন্তরিকতা, পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, মানসিক সহায়তা, মন দিয়ে রোগীর কথা শোনা, চিকিৎসা বিষয়ে রোগীর সন্তুষ্টি, রোগ সম্পর্কে পরিষ্কার করে বলা, ব্যবস্থাপত্র স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা, সামাজিক অবস্থানের কারণে বৈষম্য না করা এবং চিকিৎসকের ওপর আস্থা—এ নয়টি সূচকে মতামত নেওয়া হয়েছিল।

গবেষণায় ফলাফল বলছে, গড়ে ৬৭ শতাংশ রোগী নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন, ৩৩ শতাংশ রোগী চিকিৎসকদের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী বলেছেন, চিকিৎসকেরা যথেষ্ট সময় দেন না, সামাজিক অবস্থান বুঝে রোগীর সঙ্গে কথা বলেন এবং ব্যবস্থাপত্র স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন না। ৬০ শতাংশ রোগী চিকিৎসায় সন্তুষ্ট নন এবং তাঁদের কোনো আস্থা নেই চিকিৎসকের ওপর।

অন্যদিকে, ৭৭ শতাংশ চিকিৎসক মনে করেন, অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা ঘটলে তাঁদের নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ৭১ শতাংশ চিকিৎসক বলেছেন, রোগী বা তাঁদের স্বজনেরা চিকিৎসার ব্যাপারে সহযোগিতার মনোভাব দেখান না।

রাতে সহিংসতা বেশি

যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা সাময়িকী ফ্রন্টিয়ার্স ইন ফিজিওলজি ২০২১ সালের ৩ ডিসেম্বর চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের সেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের আটজন গবেষক প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। গবেষকেরা তথ্যের উৎস হিসেবে ‘প্ল্যাটফর্মে’ প্রকাশিত ১৫৭টি ঘটনাকে বেছে নিয়েছেন। প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মঞ্চ।

গবেষণা ফলাফল বলছে, সহিংসতার পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছিলেন চিকিৎসকেরা। এর মধ্যে আছে: রোগীর সামাজিক প্রেক্ষাপট, বিলম্বে চিকিৎসা, পেশিশক্তির চর্চা, মৃত্যু ঘোষণা, তীব্র সহিংসতা এবং সেবা গ্রহণের সংস্কৃতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয় বিলম্বে চিকিৎসা দেওয়াকে কেন্দ্র করে। ২৭ শতাংশ সহিংসতা হয় এ কারণে। এরপর আছে পেশিশক্তির চর্চা। ২৬ শতাংশ সহিংসতা হয় এ কারণে।

১৫৭টি ঘটনায় মোট ১৬৫ জন চিকিৎসক আহত হন। তাঁদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ পুরুষ চিকিৎসক, ১৪ শতাংশ নারী চিকিৎসক। ৬১ শতাংশ ঘটনা ঘটে রাতে, ২৭ শতাংশ সন্ধ্যায় এবং সকালে ১৩ শতাংশ।

দেশে এ রকম আরও গবেষণা আছে। বৈশ্বিকভাবেও বহু গবেষণা হয়েছে। এসব গবেষণার ফলাফল বা মূল বিষয়বস্তুর দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কখনো নজর দিয়েছেন বলে মনে হয় না। মনে হয় না যে তাঁরা এটিকে সমস্যা হিসেবে দেখেন। দেখেন না বলেই খুলনার এমন ঘটনা ঘটল। খুলনায় রোগীদের সেবা বন্ধ—এ দায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।