ঝরে পড়া মেয়েরা ফিরবে স্কুলে

ফাইল ছবি

করোনা মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েদের ঝরে পড়ার পেছনে বড় কারণ, বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনতে উপবৃত্তি চালু রাখা এবং বিশেষ প্রণোদনাসহ সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি আর্থিক বা অন্য যেসব কারণে মেয়েরা ঝরে পড়েছে তা মোকাবিলায় সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বাল্যবিবাহ ঠেকাতে যথাযথ পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য বাল্যবিবাহের প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করতে হবে সরকারকে।

‘ঝরে পড়া মেয়েরা স্কুলে না ফিরলে যত ক্ষতি: বাস্তবতা ও উত্তরণের পথ’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল ইউকেএআইডি।

বৈঠকে বক্তারা আরও বলেন, অর্থনৈতিক, সামাজিক, স্বাস্থ্যগত ক্ষতির কথা ভেবে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে যথাযথ পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য বাল্যবিবাহের প্রকৃত তথ্য–উপাত্ত প্রকাশ করতে হবে সরকারকে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রকাশনা নিয়ন্ত্রক রিয়াদ চৌধুরী বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েদের ঝরে পড়ার জন্য বাল্যবিবাহ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ অভিবাসনও একটি বড় কারণ। কত ঝরে পড়ছে, কেন ঝরে পড়ছে সে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর রেজিস্ট্রার খাতা থেকে। এতে তথ্য-উপাত্তের যে ঘাটতি আছে, তা দূর করা যাবে। এরপর ঝরে পড়ার হার মোকাবিলায় কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে এবং কাজটি বাস্তবায়ন করার সুনির্দিষ্ট সময়সীমা কী হবে তা নির্ধারণ করা সহজ হবে।

কাজিরা কখনো বাল্যবিবাহ পড়ান না বলে জানান বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ্‌ রেজিস্ট্রার সমিতির মহাসচিব মো. ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, বখাটের উৎপাত, নিরাপত্তাহীনতা ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাবের কারণেও বাল্যবিবাহ হচ্ছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আক্তারুজ্জামান ভূঞা বলেন, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে, তা মোকাবিলায় সরকার উপবৃত্তি, মাঠ পর্যায়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করাসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে।

সভাপতির বক্তব্যে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, বাল্যবিবাহ একজন মেয়ের জীবনে ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনে। মেয়েটির মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় চরমভাবে। কোভিডের সময় নিরাপত্তাহীনতা ও দারিদ্র্যের কারণে অনেক বাবা–মা মেয়েকে বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হয়েছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারি–বেসরকারি সবার সমন্বিত কাজ করার বিকল্প নেই।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সঠিক তথ্য সঠিক পরিকল্পনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেসব মেয়ে ঝরে পড়েছে, তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতেই হবে। মেয়েদের স্কুলে যাওয়া, স্কুল শেষের পর মেয়েটি কী করবে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে সেই পরিকল্পনা করতে হবে। কাজের সংশ্লিষ্টতা আছে এমন পরিকল্পনা করা জরুরি।

কাজিরা কখনো বাল্যবিবাহ পড়ান না বলে জানান বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ্‌ রেজিস্ট্রার সমিতির মহাসচিব মো. ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, বখাটের উৎপাত, নিরাপত্তাহীনতা ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাবের কারণেও বাল্যবিবাহ হচ্ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কোভিডে অনলাইন শিক্ষা থেকেও যেসব মেয়ে দূরে ছিল, ঝরে পড়ার হার তাদের মধ্যেই বেশি। এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত করে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাল্যবিবাহ বন্ধ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া মোকাবিলা করতে হবে।

সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মেয়েদের বাল্যবিবাহ ও ঝরে পড়ার ঘটনা আগের চেয়ে বেশি ঘটেছে।

গোলটেবিল বৈঠকে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক (যোগাযোগ) শাহানা হুদা। ধারণাপত্রে করোনাকালে বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বেড়েছে উল্লেখ করে পরিস্থিতি উত্তরণে কিছু সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, শিশু জন্মের পর তার পরিচয়পত্রে জন্মতারিখ ও পোস্টকোড যুক্ত রাখা। এই একই শনাক্তকরণ নম্বর হবে তার এসএসসি পরীক্ষার নিবন্ধন নম্বর। এটা করা গেলে ভুয়া জন্মনিবন্ধন দিয়ে বাল্যবিবাহ করা বন্ধ হবে। ভিজিডি ও ভিজিএফ কার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানোর শর্ত যুক্ত করতে হবে। উপবৃত্তি বাড়াতে হবে, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরাতে বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সানজিদা আখতার বলেন, সমতলের গ্রামে–শহরে, চর, হাওর ও পাহাড়ে ভিন্ন ভিন্ন কারণে বাল্যবিবাহ হয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার ঘটনা ঘটে। তাই এলাকাভিত্তিক সমস্যা নির্ণয় করে সমাধানের করণীয় ঠিক করতে হবে। মেয়েদের জন্য কর্মে যুক্ত হতে পারে এমন দক্ষতাভিত্তিক পাঠ্যক্রম করতে হবে।

সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ–এর পরিচালক (শিশু অধিকার ও শিশু সুরক্ষা) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েশিশুরা ঝরে পড়লে শুধু নারী উন্নয়ন নয়, জাতীয় উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে কীভাবে স্বপ্নের পথ তৈরি করতে হবে, সেই স্বপ্ন দেখাতে হবে একটি মেয়েকে।

ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি বিভাগের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েটির উপবৃত্তি বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। বাল্যবিবাহের ভয়াবহ অবস্থা এখন স্বীকার করে নিয়ে কোভিডে কত সংখ্যক বাল্যবিবাহ হয়েছে তা জানতে জাতীয় জরিপের প্রয়োজন।

ইউনিসেফ বাংলাদেশ–এর কর্মসূচি কর্মকর্তা (জেন্ডার) তাহমিনা হক বলেন, স্কুলের বাইরে একজন মেয়ে কীভাবে কারিগরি শিক্ষা নিয়ে স্বাবলম্বী হতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। বাল্যবিবাহ একজন মেয়ের জন্য কতটা ক্ষতিকর সে সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি হতে হবে।

কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের জেন্ডার সমন্বয়ক মৌসুমী শারমিন বলেন, বাল্যবিবাহ ঠেকাতে জন্মনিবন্ধনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। নগরের বস্তিতে বসবাসকারী শিশুদের ব্যাপক হারে জন্মনিবন্ধনের আওতায় আনতে স্থায়ী ঠিকানার বিষয়টি শিথিল করা দরকার।

বৈঠকে অনলাইনে যুক্ত হন কুষ্টিয়ার মুক্তি নারী ও শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মমতাজ আরা বেগম এবং দিনাজপুরের উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক উম্মে নাহার। তাঁরা জানান, এলাকায় শিক্ষক, অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত করে কুষ্টিয়ায় ৬১ জন বিবাহিত ও ১৪৫ জন অবিবাহিত মেয়ে এবং দিনাজপুরে ৫৬ জন বিবাহিত ও ৬৪ জন অবিবাহিত মেয়েকে স্কুলে ফিরিয়ে এনেছেন।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।