তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ী তেলাপোকা

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন বা হবে, এমন কথা আমরা মুখে আনতে চাই না। তবে এমন একটা অশুভ ভাবনা আমাদের সময় সময় তাড়া করে ফেরে। আমরা তখন ভয় পাই। আতঙ্কিত হই। কেননা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর-ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা আমরা ভুলিনি। তা ভোলার কথাও নয়। সেই যুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৯৪৫ সালে। যুদ্ধটি হয়েছিল মূলত ইউরোপে। তবে তাতে জড়িয়ে পড়েছিল পুরো পৃথিবী। আর প্রাণ হারিয়েছিল কোটি কোটি নিরীহ মানুষ।

সেই রকম যুদ্ধ আমরা আর চাই না। আমরা চাই না তেমনই আরেকটি যুদ্ধ হোক। তেমন আরেকটি যুদ্ধ হলে, সেটি হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এমন লোক পৃথিবীতে এখনো আছে, যারা যুদ্ধবাজ। তারা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে তালি বাজায়। বাধিয়ে দিতে চায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ একদিন লেগে যেতে পারে। তখন বিজ্ঞানী মহলের আশঙ্কা, পৃথিবীতে কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকবে না। কারণ, সেই যুদ্ধে ব্যবহূত হবে পারমাণবিক বোমা (নিউক্লিয়ার বোমা)। এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীদের ধারণা, সব প্রাণী মারা যাওয়ার অবস্থা হলেও দু-চারটি প্রাণী পারমাণবিক শক্তির বা রশ্মির সর্বগ্রাসী ধ্বংসের মধ্যেও বেঁচে থাকবে। এর মধ্যে তেলাপোকা একটি। নামেই বলছে এটি একটি ‘পোকা’। আবার গতানুগতিক কথনে ‘পোকামাকড়’ বললে ভুল হবে। কারণ, মাকড় বা মাকড়সা অন্য দলের প্রাণী, পোকা নয়।

তেলাপোকা নিয়ে বিজ্ঞানীদের এমন আশাবাদের কারণ, এ প্রাণীগুলো প্রথম ধাক্কায় (তা যত শক্তিশালীই হোক না কেন) প্রায় সব মরে গেলেও বেঁচে যাওয়া দু-একটা খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের সংগঠিত করে, নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারে। এমনকি দ্বিতীয় প্রজন্মও সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। দ্বিতীয় প্রজন্মের তেলাপোকাগুলো পারমাণবিক রশ্মিতে সহনশীল হয়ে ওঠার বা কোনো অস্বাভাবিক বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষমতা অনেক প্রাণীর চেয়ে বেশি হবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

এখানে এমন ধারণার পক্ষে আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মশা-মাছি, পোকা দমন ও এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকার জন্য বাজারে নানা ধরনের ওষুধ বা স্প্রে কিনতে পাওয়া যায়। আমরা তা যখন-তখন ব্যবহারও করি।

এখানে যা লক্ষণীয় তা হলো, প্রথম স্প্রে প্রয়োগে ওই সব কীটনাশক তেলাপোকা ও মশা-মাছি দমনে খুব ভালো কাজ করে। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ব্যবহারের সময় দেখা যায়, তা তেমন কাজ করছে না। এর অর্থ দাঁড়ায়, দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ব্যবহারের সময় পোকাগুলো নিজের দেহে ওই কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে বিষটি আর তখন তেমন কাজ করে না। কারণ, বিষাক্ত রাসায়নিক বস্তুগুলোর বিরুদ্ধে এদের দেহে অকার্যকর করার মতো একধরনের ক্ষমতা জন্মায় (detoxification)। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার বিরুদ্ধেও কোনো কোনো প্রাণী সহনশীল পর্যায়ে নিতে পারে। তেলাপোকার ক্ষেত্রেও তা সম্ভব। ইউরোনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় খনিতে একধরনের অণুজীব সহজে বেঁচে থাকতে দেখা যায়।

জীবাশ্মভিত্তিক গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবীতে কীটপতঙ্গ জাতের আবির্ভাব হয়েছিল ৩৫ কোটি বছরের কোনো এক সময় (ডেভোনিয়ান ভূতাত্ত্বিক সময়সীমায়)। সেই তুলনায় উন্নত স্তন্যপায়ী প্রাণী (ম্যামেলিয়া) এসেছে মাত্র কয়েক লাখ বছর আগে। সুতরাং, এটা সহজে অনুমান করা যায় যে, কীটপতঙ্গ ভূতাত্ত্বিক কালের সময়সীমা ধরে নানা প্রতিকূল, অস্বাভাবিক বা চরম অবস্থার মধ্যে টিকে গেছে। আমাদের পক্ষে হয়তো তা সম্ভব হতো না। কাজেই কীটপতঙ্গের প্রকৃতিতে টিকে থাকার বা তাদের সহনশীল ক্ষমতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং, বিজ্ঞানীদের তেলাপোকাকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী বলে মনে করাটা খুব একটা অযৌক্তিক মনে হয় না। তবে বিজ্ঞানের জগতে এ ধরনের কথাকে ভাবীকথন বা অগ্রকথন (Prediction) বলা হয়ে থাকে। তা যে সব সময় সত্য হবে, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না।

এই সূত্র ধরে তেলাপোকা সম্পর্কে কিছু সাধারণ কথা জেনে নেওয়া যেতে পারে।

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ আণবিক বিজ্ঞানী ও খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।