বিস্ময়কর বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং

পারটার মনে হয় একটা ফয়সালা হতে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত এবং ‘আইনস্টাইনের পর সবচেয়ে মেধাবী বিজ্ঞানী’ স্যার স্টিফেন উইলিয়াম হকিং মনে হচ্ছে নোবেল পুরস্কারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন। বিজ্ঞানী মাত্রই কখনো না কখনো নোবেল পুরস্কার পেলেও পেতে পারেন। তাই বলে এ নিয়ে এমন আলোচনা আগে কখনো হয়নি। এর একটা কারণ আলফ্রেড নোবেল নিজে। অন্যটি হলো স্টিফেন হকিংয়ের জনপ্রিয়তা। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা ও পরীক্ষার ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে, এই দুইয়ের এক মিলন ঘটাতে যাচ্ছে।

বছর কয়েক আগের কথা। এক বড় মিলনায়তনে বক্তৃতা করছেন হুইলচেয়ারের বিজ্ঞানী। স্লাইডের পর স্লাইড আসছে, কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। হঠাত্ করে সবাই নড়েচড়ে বসলেন। কারণ, পর্দায় বড় করে একটা নোবেল পুরস্কারের ছবি! শোনা গেল, হকিংয়ের ধাতব কণ্ঠস্বর: ‘যদি কম ভরের কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কৃত হয়, তাহলেই আমি নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাব।’

নোবেল পুরস্কার নিয়ে হকিংয়ের ঠাট্টা প্রায় সর্বজনবিদিত। আলফ্রেড নোবেল যখন তাঁর পুরস্কারের উইল করেছিলেন, তখন সেখানে কয়েকটা শর্ত জুড়ে দেন। বড় অংশ জুড়ে ছিল ‘ব্যবহারিকভাবে প্রমাণিত’ এই বাক্যটি। আর এ কারণে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের এই পুরস্কারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘদিন। আইনস্টাইনও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। নোবেল কমিটি আইনস্টাইনকে পুরস্কার দিয়েছে ১৯২২ সালে। ১৯১৯ সালের সূর্যগ্রহণের সময় আর্থার এডিংটনের পর্যবেক্ষণের পর এবং শেষ পর্যন্ত পুরস্কারের বর্ণনায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আলোর তড়িত্ ক্রিয়ার ব্যাপারটাও জুড়ে দেন। আর হকিংয়ের জন্য অপেক্ষার প্রহরটা এরই মধ্যে ৪২ বছর হয়ে গেছে!

বিশ্বখ্যাত টাইমস ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক মন্তব্যে হকিং জানুয়ারি মাসে বলেছিলেন—তিনি এমনভাবে কাজ করছেন, যাতে কৃষ্ণগহবরকে নিয়ে তাঁর কাজটা সত্য বলে প্রমাণিত হতে পারে। তবে এই আগস্টে নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত এক নিবন্ধের ফলাফল সত্য হলে হকিংয়ের এই অপেক্ষার পালার অবসান হবে।

নোবেল কেন চাই?

হকিংকে বলা হয় পৃথিবীর বর্তমান সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। কতটা প্রতিভাবান—বলা মুশকিল। পুরস্কার আর স্বীকৃতির কথাই ধরা যাক। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর একটি আবক্ষমূর্তি আছে। ওনার নামে একটা ভবনও আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনেও তাঁর একটি মূর্তি আছে। এল সালভাদরের রাজধানী সান সালভাদরের বিজ্ঞান জাদুঘরটির নাম স্টিফেন হকিং বিজ্ঞান জাদুঘর। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রানি তাঁকে ইতিমধ্যে অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার এবং অর্ডার অব দ্য কম্প্যানিয়ন অনারে ভূষিত করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পদক। পেয়েছেন অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের সর্বোচ্চ সম্মান অ্যালবার্ট আইনস্টাইন পদক। ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে, তাঁর পুরোনো অক্সফোর্ডসহ। আর ১৯৭৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হকিংকে বানায় গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর, একসময় যে পদ অলংকৃত করেছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। ২০০৯ সালে আবারএ এই পদে যোগ দেন। সর্বশেষ এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালক। এর আগে ১৯৭৪ সালেই রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির ফেলো হয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালে পেয়েছেন বিবিভিএ ফাউন্ডেশন ফ্রন্টিয়ার অব নলেজ অ্যাওয়ার্ড। সত্যি কথা বলতে কি, কেবল নোবেল পাওয়াটাই তাঁর বাকি আছে!

আমাদের মতো?

স্টিফেন হকিং একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক ৩০০ বছরের দিনে, ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি তাঁর জন্ম ইংল্যান্ডে। দিনটা কী মহিমান্বিত? হকিং মানতে নারাজ। কারণ, ওই দিনে আরও অনেক শিশুর জন্ম হয়েছে কেবল ইংল্যান্ডেই। অক্সফোর্ড কেমব্রিজে পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে তাঁর এই মোটর নিউরন ডিজিজটা ধরা পড়ে। বিয়ের আসরেই অভ্যাগতরা জানতেন, হাশিখুশি হকিং আসলে আর মাত্র কিছুদিন বাঁচবেন। কিন্তু মোটর নিউরন ডিজিজ নিয়েই তিনি বেঁচে আছেন ৫৪ বছর! অসুখ তাঁর চলত্শক্তি আর বাকশক্তি কেড়ে নিয়েছে। ইচ্ছে করলেই তিনি তাঁর তিন নাতি-নাতনির সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারেন না। কিন্তু তাঁর তীক্ষ মস্তিষ্কের ক্ষমতার কোনো হেরফের হয়নি। তাই দিয়ে তিনি একটি বিশেষ কম্পিউটার ব্যবহার করে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আর এ নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান আইনস্টাইনের জগতে।

১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান আপেক্ষিতার সমীকরণের সমাধান করেন। তাতে দেখা যায়, এই দুনিয়া (Universe) ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নিউটনের স্থির দুনিয়া তত্ত্বের লোকজন এতে আঁতকে ওঠেন, খোদ আইনস্টাইনও এই সমাধান নাকচ করেন। কিন্তু ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল দুরবিন দিয়ে সত্যটা দেখে ফেলেন— দুনিয়া আসলেই সম্প্রসারিত হচ্ছে! গ্যালাক্সিগুলো পরস্পরের কাছ থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। অর্থাত্ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি আমরা পেছনে যাই, তাহলে একসময় দেখা যাবে, এই দুনিয়ায় সবকিছু এক বিন্দুতে ছিল। কোনো এক ঘটনায় সবাই দিগিবদিক হয়ে ছুটে চলেছে। এ থেকে উদ্ভব বিগ ব্যাং তত্ত্বের (মহাবিস্ফোরণ), যা আজকের কসমোলজির প্রাণ।

বিগ ব্যাংয়ের সমস্যা অন্যত্র। দুনিয়ার সবকিছুকে এক জায়গায় জড়ো করলে যা হয়, তাতে বিজ্ঞান একটু অস্বস্তিতে পড়ে। কারণ, এক বিন্দুর দুনিয়ার নাম সিঙ্গুলারিটি, যাতে জানা সমীকরণগুলোর ভগ্নদশা। ষাটের দশকে রজার পেনরোজের সঙ্গে হকিং তাঁর প্রথম গবেষণায় এ নিয়ে কাজ করলেন। বললেন, যতই আপত্তি থাকুক, সিঙ্গুলারিটি থেকেই দুনিয়ার শুরু। শুধু তা-ই নয়, বিগ ব্যাং থেকেই সময়েরও শুরু। অর্থাত্, বিগ ব্যাংয়ের আগে বলে কিছু নেই। সময়ের শুরুর ধারণা জেনে হকিং এগোলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। এরই মধ্যে জানা হয়েছে, বস্তুজগতে এমন বস্তু সম্ভব, যার থেকে দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুতযান আলোও বের হতে পারে না—ব্ল্যাকহোল, কৃষ্ণবিবর। ব্ল্যাকহোল কি আসলেই ব্ল্যাক? কিছুই কি সেখান থেকে বের হতে পারে না? হুইলচেয়ারের বিজ্ঞানী ভাবেন। সেই সঙ্গে ভাবেন, এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে অন্য কোথাও। হকিং এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করলেন ভিন্ন এক জগতে—কোয়ান্টাম জগতে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নানান বিষয় খোদ আইনস্টাইন মানতে পারতেন না। হকিং ভাবেন, কৃষ্ণবিবরই কি সেই বস্তু, যেখানে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মিল হবে?

হুইলচেয়ারের বিজ্ঞানী ভাবেন। ভাবেন, কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব নিয়ে। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটো কোয়ান্টাম রাশির যুগপত্ নিশ্চয়তা নেই। শূন্যস্থানে এই তত্ত্বের প্রয়োগ এরই মধ্যে বলে ফেলেছে শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। মানে অনিশ্চয়তার তত্ত্বের কারণে কোনো একটা স্থান আসলে শূন্য শক্তির হতে পারবে না। তা-ই যদি না হবে, তাহলে সেখানে কী হয়?

সেখানে প্রতিনিয়ত তৈরি হয় কণা ও প্রতিকণা। পরমুহূর্তে সেগুলো আবার পরস্পরকে আঘাত করে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাদের এই জন্ম-মৃত্যু কিন্তু বাঁচিয়ে দিচ্ছে ফিজিকস—পদার্থবিজ্ঞানকে। কারণ, তখন বেঁচে যাচ্ছে কোয়ান্টাম তত্ত্ব।

হকিং এই ঘটনাকে প্রয়োগ করলেন ব্ল্যাকহোলের আশপাশে। ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণবিবরের ব্যাপারটা আগে একটু ফিরে দেখা যাক। মহাজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম বস্তুটিকে কিন্তু দেখাই যায় না। কৃষ্ণবিবরের আলোচনায় আমাদের উপমহাদেশের বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরের নামও এসে পড়ে। তিনি প্রথম ভেবেছিলেন যদি কোনো তারার ভর সূর্যের চেয়ে অনেক বেশি হয়, তাহলে কেমনে তার মৃত্যু হবে?

তারার আবার মৃত্যু কী? তারার মৃত্যু হলো তার ভেতরের জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। যেমন সূর্যের মধ্যে হাইড্রোজেন পুড়ে পুড়ে হিলিয়াম হচ্ছে। এই যে জ্বলুনির শক্তি, সেটি ঠেকিয়ে রাখছে সূর্যের ভেঙে পড়াকে। কারণ, জ্বলুনির শক্তি না থাকলে নিজের ভরে সূর্যের সব উপাদান কেন্দ্রীভূত হয়ে যেত। কিন্তু যখন হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যাবে, তখন মহাকর্ষের টানে সব পদার্থ এসে পড়বে কেন্দ্রে। সূর্য হয়ে যাবে আকারে ছোট। কিন্তু তখন আবার সেটার কেন্দ্রে তাপমাত্রা এত বেড়ে যাবে যে হিলিয়াম তখন জ্বলতে শুরু করবে।

চন্দ্রশেখর হিসাব-নিকাশ করে দেখালেন, যদি অনেক বড় তারা হয়, তাহলে শ্বেতবামনত্ব, নিউট্রনতারাত্ব ইত্যাদি ছাপিয়েও তারা শেষ পর্যন্ত এমন হয় যে, তার মহাকর্ষ হয়ে যায় অনেক বেশি। কত বেশি? তার মুক্তিবেগ হয় আলোর বেগের চেয়ে বেশি। ফলে আলোও আর সেখান থেকে বের হতে পারে না। তারা তখন কৃষ্ণবিবর হয়ে শান্তি পায়। এই যে তার শক্তি, সেটা ঠিক রাখার জন্য কৃষ্ণবিবর তৈরি করে একটা দেয়াল, যাতে আমরা তার জগতে ঢুকতে না পারি। বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন ঘটনা দিগন্ত—ইভেন্ট হরাইজন।

ঘটনা দিগন্তের ওখানে হকিং আমদানি করলেন অনিশ্চয়তার তত্ত্ব। তার মানে, সেখানে অনবরত তৈরি হচ্ছে কণা-প্রতিকণা। ঝামেলা হচ্ছে এরপর, কারণ, কোনো কারণে এই জোড়া কণার কোনো একটা যদি ঘটনা দিগন্তের অপর পাশে চলে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে খেয়ে ফেলে ব্ল্যাকহোল। ফলে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে অপর কণাটি। সবেগে সেটি তখন বের হয়ে যাচ্ছে ব্ল্যাকহোল থেকে। এই বের হয়ে যাওয়া কণাটি ভরটা পাচ্ছে কোথা থেকে? ওই কৃষ্ণবিবর থেকে। কারণ, যেটি বিবরের ভেতরে পড়েছে, সেটির ভর তো ঋণাত্মক। আর দুইয়ে মিলে ছিল শূন্য!

কাজেই দাঁড়াল, ব্ল্যাকহোল আসলে ব্ল্যাক বা কালো নয়। এ থেকে বের হয়ে আসছে কণাস্রোত। ১৯৭৩ সালে হকিং প্রকাশ করলেন তাঁর ধারণা এবং অচিরেই তা গৃহীত হলো। বিজ্ঞানজগত্ ওই বিকিরণকে অভিহিত করল হকিংয়েরই নামে, হকিং রেডিয়েশন।

ব্ল্যাকহোল থেকে বিকিরণ আসতে থাকলে তো একসময় সেটি ফুরিয়ে যাবে, তবে তার জন্য অ-নে-ক বছর লেগে যাবে। কিন্তু হকিং গবেষণা করে দেখালেন, কেবল তারা মৃত্যুতে নয়, বরং সৃষ্টির শুরুতেও ছোট ছোট ব্ল্যাকহোলের জন্ম হতে পারে। এবং সেগুলো একসময় আর্তনাদ করে নিজেকে বিলীন করে দিতে পারে।

হকিংকে নোবেল পুরস্কার দিতে না পারার একটা কারণ হলো, বাস্তবে একটা ব্ল্যাকহোল থেকে হকিং বিকিরণ বের হয়ে আসছে কি না, সেটা মাপার মতো কারিগরি দক্ষতা এখনো মানুষের আয়ত্ত হয়নি। তাহলে বাকি থাকে ল্যাবরেটরিতে একটা ব্ল্যাকহোল বানানো! একটা সম্ভাবনা ছিল ইউরোপের সার্নে অবস্থিত লার্জ হেড্রন কলাইডারে। সেখানে কণাদের মারামারি-ধাক্কাধাক্কিতে খুবই ছোট ব্ল্যাহহোল সৃষ্টি হতেও পারে। যদিও এখনো তার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।

তবে হকিংয়ের জন্য সুখবর এসেছে অন্য জায়গা থেকে। ১৯৮০ সালে ভ্যাংকুভারে ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী বিল আনরু হকিং বিকিরণ পরীক্ষা করার একটা ভিন্ন পদ্ধতি প্রস্তাব করেন। তিনি এমন একটি মাধ্যমের কথা ভাবলেন, যা কিনা ত্বরিত গতিতে চলমান। জলপ্রপাতের বেলায় এটি দেখা যায়। জলপ্রপাতের একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছালে কোনো সাঁতারুই এমন গতিতে সাঁতার কাটতে পারে না, যা জলপ্রপাতের আকর্ষণকে নাকচ করতে পারে। ফলে সে যেমন সাঁতারুই হোক না কেন, তাকে জলপ্রপাতে আত্মসমর্পণ করতেই হয়। আনরুর বক্তব্য ছিল, এটিই একটি ঘটনা দিগন্ত। কাজেই শব্দের জন্য যদি কোনো ‘ব্ল্যাকহোল’ বানানো যায়, তাহলেই হকিং বিকিরণ সেখানেও দেখা যাবে।

সম্প্রতি বিজ্ঞানী স্টেইনহওয়ার ঠিক এই কাজটা করেছেন। তিনি রুবিডিয়াম পরমাণুর একটি মেঘমালার তাপমাত্রাকে নিয়ে গেলেন পরম শূন্যের (-২৭৩ ডিগ্রি কেলভিন) সামান্য ওপরে। ফলে রুবিডিয়াম পরমাণুর মেঘমালাটি চলে যাচ্ছে বোস-আইনস্টাইন ঘনায়ন (BEC—Bose Einstein Condensate) নামের এক কোয়ান্টাম স্তরে। সেগুলোকে দিয়ে বানানো হলো চুরুটের মতো লম্বা একটি আকৃতি, যা কিনা মাত্র কয়েক মিলিমিটার লম্বা। এতে শব্দের গতিবেগ দাঁড়াল সেকেন্ডে আধা মিলিমিটারের মতো। তারপর তিনি ওই পরমাণুগুলোকে ত্বরণ দিয়ে এমন অবস্থায় আনলেন যে, কোনো কোনো কণার গতিবেগ হয়ে গেল সেকেন্ডে এক মিলিমিটারের বেশি। ফলে তৈরি হয়ে গেল শব্দের জন্য একটা ঘটনা দিগন্ত!

আর ওই স্বল্প তাপমাত্রায় বিইসি খুবই দুর্বল কোয়ান্টাম চাঞ্চল্যের ভেতর দিয়ে যায়। এর ফলে সেখানে তৈরি হয় শব্দের জোড়া কণা, ফোনোন। ব্ল্যাকহোলে যেমনটি হয় ফোটন কণা। আর এই ফোনোন কণার একটা হারিয়ে যাচ্ছে বিইসির এক পাশে আর অন্য পাশে আবির্ভূত হচ্ছে অপরটি। স্টেইনহওয়ারের মতে, এর একটাই অর্থ, বিইসি থেকে বের হয়ে আসছে হকিং বিকিরণ!

বিজ্ঞানীরা এখনো এই ব্যাপারটাতে নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে সবাই এটি মেনেছেন যে, স্টেইনহওয়ারের পরীক্ষা সফল হওয়ার মানেই হচ্ছে হকিং বিকিরণ প্রমাণিত হওয়া। আর তাই অনেকেই এই পরীক্ষণটি নিজেরা করবেন বলে ঠিক করেছেন। আর সত্যি সত্যি যদি শব্দের ব্ল্যাকহোলের হকিং বিকিরণ হয়, তাহলে স্যার উইলিয়াম স্টিফেন হকিংয়ের নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা হবে সময়ের ব্যাপার মাত্র।

গুড লাক, স্টিফেন হকিং!

লেখক: গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক