মহাকাশ, এই যে আমি কিন্তু আসছি!

আমার আসলে অভিযানে যেতে কোনো ভয় লাগে না। আমার সামনে কোনো পিলে চমকানো সুযোগ তৈরি হলেই সেটি লুফে নিই আমি। কয়েক বছর আগে আমি তো আমার হুইলচেয়ার নিয়েই সান ফ্রান্সিসকোর সবচেয়ে খাড়া পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার অভিযানে নেমেছিলাম। আমি অনেক ঘোরাঘুরি করি। অ্যান্টার্কটিকা আর ইস্টার আইল্যান্ডেও গিয়েছি। সাবমেরিনেও ডুব দিয়েছি আমি।

২০০৭ সালে আমার ৬৫তম জন্মদিনের তিন মাস পর বিশেষ কিছু করেছিলাম। সেবার জিরো গ্র্যাভিটি উপভোগ করেছিলাম। সেই অভিযানে আমার অক্ষমতাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এড়াতে পেরেছিলাম; সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলাম। চল্লিশ বছর হুইলচেয়ারে চলার পরে আমি ভেসে ছিলাম। প্রায় চার মিনিট ওজনহীন অবস্থায় দারুণ সময় কাটিয়েছিলাম। বিশেষায়িত এক বোয়িং ৭২৭ জেট বিমানে চড়ে ফ্লোরিডার আকাশে উড়েছিলাম সেবার। দারুণ ছিল সেই অভিযান। মহাকাশে ঘোরার স্বপ্ন আমার অনেক দিনের। জিরো গ্র্যাভিটি আমাকে সেই অভিজ্ঞতাই দিয়েছিল। আমি উড়ছিলাম।

রিচার্ড ব্রানসনের ভার্জিন গ্যালাকটিক স্পেসশিপ টু ভিএসএস ইউনিটি মহাকাশে যাত্রা করবে সেই সফরেও ভাগ বসাব আমি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে প্রথম দলের যাত্রী হয়ে ভিএসএস ইউনিটির মাধ্যমে মহাকাশে যেতে পারব। আমাকে যখন প্রথম এই সুযোগের কথা বলা হয়, আমি চোখ বন্ধ করেই হ্যাঁ বলেছি। পঞ্চাশ বছর ধরে অ্যামাইয়োট্রপিক ল্যাটারেল স্কেলেরোসিস—এএলএস রোগে ভুগছি। একুশ বছর বয়সে যখন আমার এই রোগ ধরা পড়ে তখন আমাকে চিকিত্সকেরা বলেছিলেন, আর মাত্র দুবছর বাঁচব আমি। কিন্তু কেমব্রিজে পিএইচডি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। তারপর মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণায় মন দিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম আমি। দিনে দিনে আমার শরীর তখন দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। যতই শরীর দুর্বল হচ্ছিল ততই আমার মন শক্ত হচ্ছিল। একসময় আমার হাত দুটো অকেজো হয়ে যায়। ফলে আমি সমীকরণ লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। লিখতে না পারলেও আমার মনকে অভিযাত্রী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। মহাবিশ্বে মন দিয়ে ঘুরতে যাওয়ার ক্ষমতা, মন দিয়ে মহাবিশ্বকে দেখার ক্ষমতা নিজের মধ্যে বিকাশ করতে থাকি।

আমার বেঁচে থাকার বড় শক্তিটি ছিল শক্ত একটা মন। জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় গলার সামনে মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকা আমাকে প্রতি মুহূর্তকে গুরুত্ব দিতে শেখাচ্ছে। শৈশবে অনেকটা সময় আকাশ আর নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু দেখেছি। অবিনশ্বর এই মহাবিশ্ব-সময়ের শেষ কোথায় তাই ভেবে বিস্মিত হতাম। বড় হয়ে নিজেকে বেশ কবার জিজ্ঞেস করেছিলাম: আমরা কেন এখানে? আমরা কোথা থেকে এসেছি? ঈশ্বর কি মহাবিশ্ব তৈরি করেছেন? জীবনের অর্থ কী? মহাবিশ্ব কেন টিকে আছে? অনেক প্রশ্নের উত্তর জানতে পেরেছি। কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনো নিজেকে করে যাচ্ছি আমি।

আমার বিশ্বাস, আমাদের এমন একটা নতুন প্রজন্ম প্রয়োজন যারা সৌরজগত্ অভিযানে বের হবে, কিংবা সৌরসীমানাকে ছাড়িয়ে যাবে। আমরা এখন মহাকাশ গবেষণায় নতুন যুগে পা রেখেছি। এই সাফল্য আমাদের পৃথিবীকে দারুণভাবে বদলে দিয়েছে। ভবিষ্যতের মানবসভ্যতা রক্ষায় এই অভিযান দারুণভাবে কাজে আসবে বলে বিশ্বাস করি আমি।

বাণিজ্যিকভাবে মহাশূন্যে ভ্রমণের কারণে এই সম্ভাবনা আরও বাড়বে। আমার মনে হয় নিউক্লিয় কোনো যুদ্ধের মতো কিংবা জেনেটিক্যালি তৈরি কোনো ভাইরাস বা অন্য কোনো কারণে পৃথিবীর প্রাণ ভয়ানক কোনো বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। মহাকাশে যদি মানব বসতি স্থাপন করা না যায়, তাহলে মানব প্রজাতির কোনোই ভবিষ্যত্ নেই বলে আমার ধারণা। মহাকাশ গবেষণার জন্য আগামী প্রজন্মকে উত্সাহ দেওয়া উচিত। তাদের কাছে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া উচিত। আমরা মহাকাশে গেলে কী খুঁজে পাব? আসলেই কি কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী আছে? নাকি আমরাই একা? মঙ্গলবুকে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে কেমন লাগবে?

আমার হুইলচেয়ার এই পৃথিবীপৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আমি এসব স্বপ্নই দেখি, দেখেই যাব। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোনোই সীমানা নেই। তোমার মনের সীমানা বাড়াও। মনের মধ্যে সাহস আনো, আর বিনয়ী হও। নিজের পায়ের দিকে নয়, নক্ষত্র-তারার দিকে তাকাতে শেখো। মহাকাশ, এই যে আমি কিন্তু আসছি!

লেখক জুলিয়ান গাটরেইর বই হাউ টু মেক আ স্পেসশিপ-এর এই নিবন্ধটি লিখেছেন স্টিফেন হকিং। দ্য গার্ডিয়ান-এ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল নিবন্ধটি।

অনুবাদ: জাহিদ হোসাইন খান