পিঁপড়ার বিয়ে!

কসময় শুধু অজপাড়াগাঁয়েই নয়, খোদ ঢাকা শহরে এমন দৃশ্য খুব বিরল ছিল না। অবশ্য সেই ঢাকার সঙ্গে আজকের রাজধানীর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখন ঢাকা ছিল অনেক ছোট। সেই পুরোনো শহরে এমন একটা দৃশ্য অনেক সময় দেখা যেত যে সলজ্জ মুখে রুমালচাপা দিয়ে বর হেঁটে যাচ্ছেন কনের বাড়ি। আশ্চর্যজনক মনে হলেও আমরা কখনো কখনো দেখি, একদল পিঁপড়া কোনো ফাঁকা জায়গা বা সড়কের খানিকটা অংশজুড়ে উড়ছে। বেসামাল হয়ে ছোটাছুটি করছে। এমন দৃশ্য দেখে আমরা অনেকেই হয়তো এটাকে তুচ্ছ কোনো ঘটনা বলে উপেক্ষা করে চলে যাব। কিন্তু পিঁপড়াদের এই মহড়া-উত্সবের কার্যকারণের বিষয়টি আমাদের অনেকেরই জানা নেই।

আসলে পিঁপড়া জাতের এই শ–ন্যে ওড়াউড়ি এক ‘বিবাহ উত্সব’ ছাড়া আর কিছু নয়। ‘পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে’—এই প্রবাদবাক্যটি আমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। আমাদের চারপাশের মানুষ বা আত্মীয়স্বজন যখন আচার-ব্যবহারে আমাদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন আমরা এই মোক্ষম প্রবাদটি তাকে থামানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি। আমরা বাক্যটিকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করলেও পিঁপড়ার ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক, যা মরার জন্য নয়। তা এদের জীবনচক্রের উত্সবমুখর এক প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডই বটে। প্রাণিবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হয় ‘নাপশিয়াল ফ্লাইট’ (Nauptial Flight) যা বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘পরিণয়-উড্ডয়ন’। সহজ করে বলা যায়, ‘বিয়ের উড়াল’। এই পরিণয় উড্ডয়ন আসলে পিঁপড়ার প্রজননতন্ত্রের অতিপ্রয়োজনীয় উপলক্ষ।

পিঁপড়া সমাজবদ্ধ জীব। এরা দল বেঁধে বাসা বানায় বা পিঁপড়ার ঢিবি বানিয়ে তাতে বসবাস করে। এদের রয়েছে বর্ণপ্রথা (Cast pysten) অর্থাৎ এদের বাসায় কয়েক ধরনের পিঁপড়া দেখা যায়। এর মধ্যে রানি, পুরুষ, সৈন্য ও কর্মী পিঁপড়া থাকে। রানি ও পুরুষ পিঁপড়ার পাখা থাকে। সৈন্য ও কর্মী পিঁপড়া পাখাহীন, উড়তে পারে না।

পিঁপড়ার কলোনি গঠন ও সংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটা শুরু হয় রানি ও পুরুষ সদস্যের ওড়াউড়ির মধ্য দিয়ে, যাকে বলা হচ্ছে পরিণয় উড্ডয়ন। একটি পিঁপড়া দলে এমন উপলক্ষ সাধারণত বছরে একবারের বেশি হয় না। উড়ন্ত অবস্থায় স্ত্রী ও পুরুষ পিঁপড়ার মিলন ঘটে। এ অবস্থা চমকপ্রদ ও কিছুটা বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে এই মিলনের পরপরই পুরুষ পিঁপড়া মারা যায়। এর কারণ বিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট নয়। এরপর পুরুষ পিঁপড়ার বংশবিস্তারে আর কোনো ভূমিকা থাকে না। অন্যদিকে রানি পিঁপড়া নিজের পাখা ফেলে দিয়ে ডিম দেওয়া ও বংশবৃদ্ধির জন্য একটি সুরক্ষিত বাসা বা গর্ত খুঁজে নেয়।

পিঁপড়া পরিচিতি

পিঁপড়া কীটপতঙ্গ (ইনসেক্টা) শ্রেণির ফর্মিসিডি গোত্রের একটি সুশৃঙ্খল প্রাণীদল। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র এদের বিস্তার। এদের দেহ মাথা, ধড় ও উদর তিন ভাগে বিভক্ত। এর তিন জোড়া পা ও দুই জোড়া পাখা থাকে। পাখাগুলো ছোট বা অপরিণত বলে বেশির ভাগ সময় আমাদের চোখের আড়ালে থাকে। কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হলেও পৃথিবীতে যত পিঁপড়া আছে, তাদের জৈববস্তু (বারো মাস) পৃথিবীতে বসবাসকারী ৭০০ কোটির মানুষের জৈববস্তুর সমান। পৃথিবীতে পিঁপড়া প্রজাতির সংখ্যা ২২ হাজারের মতো। বাংলাদেশে পিঁপড়া প্রজাতির সংখ্যা ১৩০ থেকে ২৫০।

প্রায় সব ধরনের খাবারের আশপাশে এগুলোকে দেখতে পাওয়া যায়। তবে এদের খাদ্যের ভিন্নতা আছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। তাহলেও সাধারণভাবে এদেরকে সর্বভূক বলা যায়। কেননা প্রয়োজনে খাদ্যাভাব দেখা দিলে এরা নতুন খাদ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে।

পিঁপড়া কৃষকের ফসলে ভাগ বসায়। আবার এগুলো ফসলের অপকারী কীটপতঙ্গ খেয়ে কৃষকের উপকারও করে। আমাদের জনপ্রিয় পিঁপড়ার মধ্যে Monomorium ও Tepinosa প্রজাতি উলে–খযোগ্য। পিঁপড়ার কামড় মোটামুটি যন্ত্রণাদায়ক। কারণ, এদের লালায় ফলিক অ্যাসিড থাকে, যা এই যন্ত্রণার কারণ।

উন্নত বিশ্বে প্রায় সব ধরনের ছোট বড় প্রাণী নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করেন। পিঁপড়া ছোট হলেও এই তালিকা থেকে বাদ যায় না। আমাদের দেশের গবেষণা কর্মকাণ্ড খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, ৫০-৬০ বছরের ইতিহাসে মাত্র দু-একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পিঁপড়া নিয়ে কাজ করেছেন।

লেখক পরিচিতি: সাবেক জ্যেষ্ঠ আণবিক বিজ্ঞানী ও খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।