লাখো কোটি গ্যালাক্সির এ মহাবিশ্ব

বিংশ শতাব্দীতে প্রবেশের শুভলগ্নে জ্যোতির্বিদেরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে মহাবিশ্বে মাত্র একটি গ্যালাক্সি আছে। নাম মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। সেখানে সূর্যের মতো প্রায় ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র আছে। যদিও আঠরো শতকের ডারবানের টমাস রাইট ও দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট প্রত্যেকের মোটামুটি একটি অনুমান ছিল। অনুমানটি হলো, টেলিস্কোপে দেখা আকাশে সর্পিল প্রভাময় বিন্দুবৎ কাঠামোগুলো আসলে অন্যান্য গ্যালাক্সি। কান্ট স্পষ্টভাবে ধারণা করেছিলেন যে অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জের ভেতর এম১৩ আসলে আরেকটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। সেটি বিশালসংখ্যক নক্ষত্র দিয়ে গঠিত। তাঁরা এগুলোকে ‘দ্বীপ বিশ্ব’ বলে ডাকার প্রস্তাব করেছিলেন। কিছু বিজ্ঞানী ওই ধারণাটি নিয়ে উপহাস করে বললেন, সর্পিল নীহারিকাগুলো হলো দূরবর্তী দ্বীপবিশ্ব নয়, বরং নিকটবর্তী অনেকটা জমাটবদ্ধ আন্তনাক্ষত্রিক গ্যাসীয় মেঘ। সম্ভবত সেখানে অন্যান্য সৌরজগত্ তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।

কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল ১৯২৪ সালে টেলিস্কোপে এম১৩ নামের আন্তনাক্ষত্রিক মেঘগুলোকে অস্বাভাবিক দূরত্বে আছে বলে চিহ্নিত করলেন, হাজার বা লাখ আলোকবর্ষ নয়, প্রায় ২০ লাখ আলোকবর্ষের চেয়েও বেশি। তা-ই যদি হয়, তাহলে এম১৩ শুধু আন্তনাক্ষত্রিক মাত্রার মেঘ হতে পারে না, এটাকে অনেক বড় হতে হবে, একটি অপরিমেয় বিশাল গ্যালাক্সির অবয়ব নিয়ে। পার্শ্ববর্তী এই গ্যালাক্সির নাম অ্যান্ড্রোমিডা এম-১৩। নিষ্প্রভতর গ্যালাক্সিগুলো হবে আরও দূরে, পরিচিত মহাবিশ্বের সীমান্তে। এভাবে ১০ হাজার কোটি গ্যালাক্সি ঝিকমিক করে ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় আছে মহাবিশ্বে।

২০১৬ সালের অক্টোবরে অবশ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির সংখ্যা প–র্বধারণার চেয়েও ২০ গুণ বেশি। প্রায় দুই লাখ কোটি গ্যালাক্সি। জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাবলের নাম অনুসারে রাখা হাবল স্পেস টেলিস্কোপ সাহায্য নিয়েই এই গবেষণা করা হয়েছে। হাবল টেলিস্কোপের ২০ বছরের গবেষণায় প্রাপ্ত ত্রিমাত্রিক ছবি থেকে একটি মডেল বানানো হয়েছে। এই মডেল থেকে ২ লাখ কোটি গ্যালাক্সির এই সিদ্ধান্তে এসেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। গ্যালাক্সিগুলো হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে লাখ লাখ থেকে শতকোটি-সংখ্যক নক্ষত্র মহাকর্ষের টানে একসঙ্গে আটকে থাকে। এই গবেষণার প্রধান বিজ্ঞানী ইউনিভার্সিটি অব নটিংহামের ক্রিস্টোফার কোনসেলাইস বলেন, ‘শুনতে চমক লাগতে পারে, কিন্তু গ্যালাক্সিগুলোর ৯০ শতাংশ নিয়েই এখনো কোনো গবেষণা হয়নি।’ তিনি বলেন, তাঁর নেতৃত্বে বিজ্ঞানী দল হাবল টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া ছবিগুলোকে ত্রিমাত্রিক রূপ দিয়ে মহাবিশ্বের সচিত্র ইতিহাস তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। ১৩৮০ কোটি বছরের তথ্য বিশে–ষণ করে ‘বিগ ব্যাং’ বা সময়ের আদিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা।

মানবজাতির আবির্ভাবের পর ২৫ লাখ বছর কেটে গেছে। এখনো এই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান অনুসন্ধান করে চলেছি। আমাদের প্রজাতির শৈশবে, প্রায় ছয় লাখ বছর আগেও যখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা আলস্যভরে ক্ষণিকের জন্য হলেও নক্ষত্রের দিকে তাকাত, যা প্রাচীন গ্রিসের আয়োনীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে, আলেক্সান্দ্রিয়াতে—এমনকি একবিংশ শতাব্দীর আমাদের যুগেও দেখেছি। অনেকেই এই প্রশ্নগুলো দিয়ে নিজেদের তাড়িত করেছে: কোথায় আমরা? কেন আমরা এখানে, কী আমাদের পরিণতি?

১৯১৫ সালের দিকে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে হ্যারলো শেপলি বেশ সাহস করে একটি প্রস্তাব করেছিলেন। প্রস্তাবটি হলো, আমাদের সৌরজগতের অবস্থান গ্যালাক্সির প্রান্তে। আজ আমরা জানি, প্রায় ৩০ হাজার আলোকবর্ষ দূর দিয়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে আবর্তন করে চলেছে আমাদের সূর্য। আমরা বাস করি সূর্যের মতো সাধারণ নক্ষত্রের একটি সাধারণ গ্রহে, যা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির প্রান্ত দুটি সর্পিল বাহুর মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে। ছুটে চলেছে পৃথিবীকে নিয়ে সেকেন্ডে ৪২ মাইল গতিতে। এভাবে প্রায় ২৫ কোটি বছরে একবার আবর্তন করে পুরো গ্যালাক্সিকে। মাঝেমধ্যে আমাদের পৃথিবী ও সৌরজগৎ এমন এক নক্ষত্র ঘনত্বের মধ্য দিয়ে যায়, যেখানে মানুষের চেয়ে নক্ষত্রের সংখ্যা বেশি। মনে রাখতে হবে, এই সময়ের মধ্যে মহাদেশের প্লেটগুলো এক হয়ে এক অবিচ্ছিন্ন স্থলভূমি তৈরি হয়েছিল। আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে আজকের মহাদেশগুলো তৈরি হয়েছে। আবার স্থলভূমির এই পরিবর্তনের মধ্যে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে ডাইনোসরের আবির্ভাব ঘটেছে এবং ১৮ কোটি বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে—প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে এ ধারণা প্রণয়ন করেছিলেন আয়োনীয় বিজ্ঞানী অ্যারিস্টারকাস। পরে তা পরিশুদ্ধ করে লেখেন পোলিশ বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস। অ্যারিস্টারকাস থেকে শুরু হওয়া মানবজাতির অনুসন্ধানের প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের মহাজাগতিক নাটকের কেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। এখনো এই নতুন ধারণাগুলোকে আত্মস্থ করার মতো যথেষ্ট সময় আসেনি। যেসব মানুষের জীবনকালের মধ্যে শেপলি ও হাবলের আবিষ্কারগুলো তৈরি হয়েছিল, তাঁদের অনেকে এখনো বেঁচে আছেন। এমন অনেকে আছেন যাঁরা গোপনে দুঃখ বা পরিতাপ করেন এই মহা আবিষ্কারগুলো নিয়ে। তাঁরা মনে করেন, এই প্রতিটি আবিষ্কার বা পদক্ষেপ হচ্ছে একটি অধঃপতন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এমন একটি বিশ্বকে, যার কেন্দ্র এবং আলম্ব হলো এই পৃথিবী, নিজেদেরও কেন্দ্রীভূত করে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হলে প্রথমে একে অবশ্যই বুঝতে হবে, এমনকি বিরোধিতাপূর্ণ হলেও।

আমাদের প্রজাতির শৈশবে উদ্ভূত এবং প্রতি প্রজন্মে নতুন করে একই বিস্ময় নিয়ে করা একটি প্রশ্ন নিয়ে আমরা মহাজাগতিক যাত্রা শুরু করেছিলাম। প্রশ্নটি হলো: নক্ষত্রগুলো কী? আর তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী? রহস্য উন্মোচন হলো আমাদের সহজাত স্বভাব। আমরা মানুষেরা যাত্রা শুরু করেছিলাম যাযাবর হিসেবে। তারপর মহাজাগতিক বেলাভূমিতে দীর্ঘকাল আমরা কাটিয়ে দিলাম। এখন আমরা নক্ষত্রের দিকে যাত্রায় পুরোপুরি প্রস্তুত। ক্রমেই ছড়িয়ে পড়া পৃথিবীর মহাকাশ অভিযান সে কথাই জানান দিচ্ছে।

লেখক: বিজ্ঞান বক্তা।