গণিত কষে ঘুষখোর ধরা

আচ্ছা, অনুমান করুন দেখি, বাংলাদেশে কত লোক ঘুষ খায়? এটি অবশ্য আন্দাজে বলা কঠিন। কিন্তু ধরা যাক, আমরা জানতে চাই কোনো এলাকায় বা ধরো কোনো অফিসে প্রায় কত লোক ঘুষ খায়। আমরা যদি মানুষকে গিয়ে এভাবে জিজ্ঞেস করি যে আপনি ঘুষ খান কি না, তাহলে তো আর সব সময় সঠিক উত্তর পাব না। এমনকি সেটি করতে গেলে ঝামেলাও বেধে যেতে পারে। হয়তো অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। কাজেই ওই পথ আপাতত বাদ দিয়ে আমরা গাণিতিক কৌশল খাটিয়ে দেখি কোনো কাজ হয় কি না। এ কৌশলের মাধ্যমে আমরা কত লোকের মধ্যে প্রায় কত লোক ঘুষ খায়, তা জানতে পারব। অবশ্য ঠিক কারা কারা ঘুষ খায়, তা জানতে পারব না।

আমরা কাজটি করব পরিসংখ্যানের সম্ভাবনার ধারণা কাজে লাগিয়ে। এই পরীক্ষাটি চালানোর জন্য প্রথমেই কিছু লোক বাছাই করতে হবে। এই সংখ্যা যত বেশি হবে ততই ভালো, অন্তত এক হাজার নিলেও মোটামুটি চলবে। তাদের আমরা বলব টার্গেট গ্রুপ। এখন সঙ্গে রাখতে হবে একটি ভালো ধাতব মুদ্রা (কয়েন)। কয়েনটিকে হতে হবে নিখুঁত, অর্থাত্ একে এমন হতে হবে, যেন টস করলে হেড ও টেইল ওঠার সম্ভাবনা সমান থাকে। এই কয়েন নিয়ে আমরা এক এক করে টার্গেট গ্রুপের ব্যক্তিদের কাছে যেতে থাকব।

ধরা যাক, আমরা গেলাম মিস্টার এক্স-এর কাছে। তাঁর কাছে প্রশ্ন থাকবে তিনি ঘুষ খান কি না। কিন্তু তাঁকে বিব্রত করা যাবে না। তা কী করে সম্ভব? সেটাই বলছি।

তাঁকে কয়েনটি দিয়ে বলতে হবে, ‘আপনি এটি টস করবেন। টসের ফলাফল আমাদের জানানো লাগবে না। একটি বিশেষ ব্যালট পেপার দেব, সেখানে দুটি ঘর থাকবে, একটিতে লেখা থাকবে “হ্যাঁ”, অপরটিতে “না”।  যদি টসে হেড পড়ে, তাহলে প্রশ্নের উত্তরে আপনি গোপনে “হ্যাঁ” ঘরে টিক চিহ্ন দেবেন। আর যদি টেইল দেখেন, তবে সত্য কথা বলবেন। অর্থাত্ যদি আপনি ঘুষ না খান, তাহলে “না” ঘরে আর ঘুষ খেলে সত্য কথাটি স্বীকার করে “হ্যাঁ” ঘরে টিক চিহ্ন দেবেন। টিক চিহ্ন দেবেন গোপনে। আপনি কোন ঘরে টিক দিয়েছেন, সেটা কেউ জানতে পারবে না’—মূল ব্যাপারটি এখানেই। মনে রাখতে হবে, উত্তর হ্যাঁ হতে পারে দুটো কারণে। এক. তিনি টস করে হেড পেয়েছেন (ঘুষ খান বা না খান) অথবা দুই, তিনি টস করে টেইল পেয়েছেন এবং সত্যি সত্যিই ঘুষ খান। অতএব, তিনি কি টসে হেড পড়াতে হ্যাঁ টিক দিয়েছেন, নাকি আসলেই ঘুষ খান বলে হ্যাঁ টিক দিয়েছেন, সেটা আমরা জানব না। ফলে তিনি নিরাপদ, তাঁর সম্মানহানি হচ্ছে না। এই কথাটি ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বলতে হবে, না হলে সৃষ্টি হবে বিব্রতকর পরিস্থিতির।

এই পরীক্ষা চালিয়ে অনেকগুলো হ্যাঁ ও না পাওয়া যাবে। ধরা যাক, এক হাজার লোকের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে মোট ৮০০ উত্তর পাওয়া গেল হ্যাঁ। অর্থাত্ ঘুষ খায় কি না এই প্রশ্নের উত্তরে ৮০০ জন হ্যাঁ বলেছে। মনে রাখতে হবে, এর মানে কিন্তু এটা নয় যে ৮০০ লোকই ঘুষ খায়। এই ৮০০ লোকের মধ্যে কিছু লোক আছে, যারা সত্যি সত্যি ঘুষ খায় বলে হ্যাঁ বলেছে। আর কিছু লোক হ্যাঁ বলেছে কয়েনে হেড পড়তে দেখে। তাহলে আমরা কীভাবে জানব কত লোক আসলেই ঘুষ খায়?

মনে করে দেখুন, পরীক্ষাটি চালানো হয়েছিল নিখুঁত কয়েন দিয়ে। এতে হেড ও টেইল পড়ার সম্ভাবনা ছিল সমান। এখন এক হাজার লোক নিয়ে পরীক্ষা চালানোর অর্থ হলো, এক হাজার বার কয়েন টস হবে। হেড ও টেইল পড়ার সম্ভাবনা সমান থাকার কারণে ধরে নেওয়া যায় যে ১ হাজার টসের মধ্যে প্রায় ৫০০টি হেড পড়েছিল। ফলে ৮০০ লোকের মধ্যে প্রায় ৫০০ লোক এমন থাকবে, যারা হ্যাঁ বলেছে টসে হেড পড়ার কারণে। এরা আসলে ঘুষ খায় কি না তা জানা যাবে না। কিন্তু বাকি ৩০০টি হ্যাঁ বলা লোক হ্যাঁ বলেছে এ জন্যই যে তারা আসলেই ঘুষ খায়। কারণ, আমরা বলেছি, টেইল পড়লে যাতে উনি সত্য কথা বলেন। কয়েন নিখুঁত হওয়ার কারণে টেইলও পড়বে প্রায় ৫০০ বার। এখন টেইল পড়ার পরও হ্যাঁ বলার অর্থ হলো, এরা আসলেই ঘুষ খায়। তার মানে আমরা পেলাম, প্রতি ৫০০ লোকের মধ্যে প্রায় ৩০০ লোক ঘুষ খায়। মজার ব্যাপার, ঠিক কি না?

কিছু বিষয় মাখায় রাখতে হবে:

১.  টার্গেট গ্রুপকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে উনি ঘুষ খান কি না, তা আমরা জানব না। উনি নিশ্চিন্তে গোপনে ব্যালটে টিক চিহ্ন দিতে পারেন।

২.  কয়েন নিখুঁত হলেও ঠিক অর্ধেক পরিমাণে হেড ও টেইল পড়বে না। দুটোর পরিমাণই হবে অর্ধেকের কাছাকাছি। ফলে আমরা যত বেশি মানুষ নিয়ে পরীক্ষা চালাব, ভুলের পরিমাণ তত কমবে।

৩. এই কৌশল খাটিয়ে একই রকম আরও অন্য পরীক্ষাও চালিয়ে দেখতে পারেন। যেমন কোনো ব্যক্তি আয়কর ফাঁকি দেয় কি না, কিংবা ধূমপান করে কি না অথবা অন্য কোনো অপরাধ করে কি না—সেগুলো বের করা সম্ভব এ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে।

এই পদ্ধতির উদ্ভাবক হলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানের অধ্যাপক শেলডন রস।

কৃতজ্ঞতায়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক স্যার ড. জাফর আহমেদ খান।

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: আ ফাস্ট কোর্স অব প্রবেবিলিটি—শেলডন রস।