বুদ্ধির চর্চা

উচ্চশিক্ষার্থে যখন রাশিয়ায় ছিলাম, তখন রাশিয়ান সমাজের নানা দিক আমাকে আলোড়িত করেছে। যেমন বাসের রেলিং ধরে তরুণের বই পড়া দেখে অশীতিপর বৃদ্ধার আসন ত্যাগ, যাতে করে তরুণটি আয়েশের সঙ্গে পড়তে পারেন। গাণিতিক ফ্যাকাল্টির ছাত্রদের জন্য রসায়নের অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতা এবং আরও কত আড়াআড়ি কম্বিনেশনের প্রতিযোগিতা। প্রতিটি শিশুর স্কুলে যাওয়ার আগে দাবার স্কুলে যাওয়া। দাবার স্কুলে ৩২টি ঘুঁটি সামনে নিয়ে চাল না দিয়ে বোর্ড পজিশন নিয়ে চিন্তা করা। যে ছেলে কিংবা মেয়ে কী কাপড় পরতে হবে কিংবা কী খাবার খেতে হবে জানে না, তারা জানে দাবার বোর্ড সামনে রেখে চাল দেওয়ার আগে চিন্তা করতে হয়। এটা একটি জাতির সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। পার্কে বসে খেলা, অবসরে খেলা, দুপুরে খাওয়ার ফাঁকে খেলা রাশিয়ার একটি সাধারণ দৃশ্য। বিদেশি যেকোনো ভালো বইয়ের রাশিয়ান অনুবাদ মুহূর্তের মধ্যে বের করা এগুলো সবই সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। দাবা খেলার সর্বজনপ্রিয়তা নিশ্চয়ই রাশিয়ানদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে।

দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে কোনো রকম মেধার চর্চাই জনপ্রিয় হতে পারেনি। যাঁরা দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তাঁদের পায়ের মাংসপেশি সবল হয়, যাঁরা মুষ্টিযুদ্ধ করেন তাঁদের নিশ্চয়ই হাতের মাংসপেশি সবল হয়, আর যাঁরা বুদ্ধির চর্চা করেন তাঁদের মস্তিষ্ক তেজস্বী হয়। আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক অন্যায়ভাবে একজন ডাক্তার সরিয়ে রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে পরীক্ষা করে দেখা গেল, নিউরনে নিউরনে যোগাযোগের ঘনত্ব স্বাভাবিক মস্তিষ্কের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। সুতরাং, যখন মানুষ চিন্তা করে, তখন এই যোগাযোগগুলো বৃদ্ধি পায় এবং মানুষের মস্তিষ্ক সমৃদ্ধ হয়। কথাটি বিশেষ করে তরুণদের জন্য প্রযোজ্য।

পৃথিবীর এক-সহস্রাংশ ভূমিতে ২৪ সহস্রাংশ মানুষের দেশকে উন্নতির সোপান বেয়ে উঠতে হলে মানবসম্পদ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে, আমাদের বুদ্ধির চর্চায় নিবেদিত হতে হবে। বুদ্ধির চর্চা সংস্কৃতির অংশ হতে হবে। সামাজিক, জাতীয় জীবনে আমরা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হই এবং সমাধানের জন্য বিদেশিদের দ্বারস্থ হই। সমস্যা সমাধানের সাফল্য নির্ভর করে আমরা তা নিয়ে কতক্ষণ লেগে থাকতে পারি। স্বয়ং আইনস্টাইন বলেছেন, তিনি তত বুদ্ধিমান নন, তবে তিনি একটি সমস্যা নিয়ে লম্বা সময় লেগে থাকতে পারেন। আমাদের দেশে একটি সমস্যা নিয়ে লেগে থাকার সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। এখন ছেলেমেয়েরা একটি সমস্যা একবার চেষ্টা করে কি না সন্দেহ। চেষ্টা করে সময় অপচয় না করে সমস্যা সমাধানের জন্য তা টিউটরের জন্য রেখে দেয়। এমনকি আমিও যখন স্কুল-কলেজের ছাত্র ছিলাম, একটি সমস্যা সমাধানের জন্য দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতাম। তাতে সময় যে অপচয় হয়েছে, তা মনে হয় না। আমাদের নিয়াজ মোরশেদ আশপাশের ১৯-২০টি দেশের মধ্যে প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার হয়েছিলেন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবেরা মস্তিষ্কের শ্রেষ্ঠত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি। অথচ আমাদের দেশে একমাত্র উদ্বৃত্ত হলো মানুষ, যাকে সম্পদে পরিণত করতে পারলেই দেশ হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধি ঠেকায় কে। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদপত্রে নিয়মিতভাবে দাবার সমস্যা দেওয়া হতো।

ছোট-বড় সবাই সেই সমস্যাগুলো সমাধান করতেন। যাঁরা সমস্যা সমাধানে সফল হতেন, তাঁরা নানা পুরস্কার ও সার্টিফিকেট পেতেন। একটি দাবার বোর্ড সামনে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সঠিক চালটি খুঁজে বের করার যে নিরন্তর চেষ্টা, তা নিশ্চয়ই রাশিয়ান জাতির সমস্যা সমাধানের দৃঢ়তা ও ক্ষমতা দুটিই বৃদ্ধি করেছে। আমাদের দেশেও অনুরূপ সংস্কৃতির সূচনা হোক, দেশের নানা সমস্যার সমাধানের জন্য যেন প্রথমে বিদেশিদের খুঁজে না বেড়াই, দেশের মানুষই যাতে দেশের সমস্যার সমাধান করে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়।

বাংলাদেশে নানা উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতির সূচনা করেছে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো। কখনো কখনো একটি খবরের কাগজের দায়িত্বে পড়ে না এমন বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে, পৃষ্ঠপোষকতা করে। এবারও দাবার সমস্যা ছাপানোর প্রস্তাবটি দিতেই কাইয়ুম ভাই লুফে নিলেন। আশা করি, এই সমস্যাগুলো সমাধান করে কিশোর, তরুণ, মধ্যবয়সী কিংবা প্রবীণেরা অনেক আনন্দ পাবেন। আমাদের তরুণ-কিশোরদের সমস্যা সমাধানের জন্য লেগে থাকার গুণটি বিকশিত হবে, আমরা প্রশংসনীয় বিশ্লেষণী ক্ষমতাসম্পন্ন মেধাবী জাতিতে পরিণত হব।