আবার আলোচনায় মহাবিশ্বের প্রসারণ

২০১১ সাল। প্রতিবারের মতো নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো। সেবার পদার্থবিদ্যায় জয়ী হলেন তিন পদার্থবিদ। তাঁদের পুরস্কার দেওয়ার কারণ, মহাবিশ্ব শুধু প্রসারিতই হচ্ছে না, প্রসারণের বেগও প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে—এই আবিষ্কার করেছেন তাঁরা। এই আবিষ্কারের ফলেই রহস্যময় ডার্ক এনার্জির উপস্থিতির ব্যাপারে সবাই একমত হলেন। এই তিন নোবেল বিজয়ীর মতে, এই ডার্ক এনার্জির প্রভাবেই মহাকর্ষের আকর্ষণ এড়িয়ে মহাবিশ্ব দ্রুততর বেগে প্রসারিত হয়ে চলেছে। এই আবিষ্কার কসমোলজির স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে আমূল বদলে দেয়। কিন্তু বর্তমানে কয়েকজন পদার্থবিদ এ তত্ত্বের সাথে একমত নন। দাবির পক্ষে তাঁদের কাছে আছে আরও বেশি পরিমাণ উপাত্ত।

২০১১ সালের নোবেল পুরস্কার ভাগাভাগি করে নেওয়া সেই তিন বিজ্ঞানী হলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সল পার্লমুটার, জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডাম রেইস ও অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রায়ান পি স্মিট। ১৯৯০-এর দশকে এই তিন বিজ্ঞানী কাজ করছিলেন টাইপ ওয়ানএ সুপারনোভা (Type 1a supernovae) নিয়ে। শ্বেত বামন (white dwarf) নক্ষত্রের জীবনের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে এ ধরনের সুপারনোভার বিস্ফোরণের মাধ্যমে। শ্বেত বামন নক্ষত্র হলো মহাবিশ্বের অন্যতম ঘন বস্তু। নিউট্রন নক্ষত্র বা ব্ল্যাকহোলরাই শুধু এদের চেয়ে বেশি ঘন হতে পারে। একটি আদর্শ শ্বেত বামন নক্ষত্র দেখতে পৃথিবীর চেয়ে সামান্য বড় হতে পারে। কিন্তু এর ভর হতে পারে আমাদের সূর্যের প্রায় সমান। সৌরজগতের ৯৯ দশমিক ৮৬ ভাগ ভরই সূর্যের একার কাছে। ১৩ লাখ পৃথিবীকে আপনি সূর্যের মধ্যে জায়গা করে দিতে পারবেন। এখন একটু ভাবুন যে কী হতে পারে, এত তীব্র ঘন বস্তু যখন নিজের মহাকর্ষের চাপে গুটিয়ে যাবে। এদের দীপ্তি (নিজস্ব উজ্জ্বলতা) হতে পারে আমাদের সূর্যের চেয়ে ৫০০ কোটি গুণ পর্যন্ত।

সব ধরনের টাইপওয়ান সুপারনোভাই বিস্ফোরণের সময় প্রায় একই রকম উজ্জ্বলতা ছড়ায়। ফলে এদের আলোর বিকিরণ পরিমাপ করে পৃথিবী থেকে এদের দূরত্ব বের করা সম্ভব। আবার ডপলার ইফেক্ট ব্যবহার পরিমাপ করা যায়—এরা কত দ্রুত গতিশীল।

পার্লমুটার, রেইস ও স্মিট টাইপওয়ান সুপারনোভার পরিচিত সব উপাত্ত বিশ্লেষণ করে হতবাক হয়ে যান। হাবল স্পেস টেলিস্কোপসহ পৃথিবীর আরও কিছু টেলিস্কোপ দিয়ে এই উপাত্তগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল। দূরের সুপারনোভাদের কাছেরগুলোর সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেল, ওরা অনেক বেশি অনুজ্জ্বল, প্রায় ২৫ শতাংশের মতো। এরা আসলে অনেক বেশি দূরে আছে। ফলে মহাবিশ্ব ক্রমেই দ্রুততর বেগে প্রসারিত হচ্ছে। এই আবিষ্কার এতটাই মৌলিক যে এটা কসমোলজির একটি বড় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। আরেকটি উত্স থেকেও এর সপক্ষে প্রমাণ মেলে। বিগ ব্যাংয়ের পরে যে কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণ ঘটেছিল, তা-ও মহাবিশ্বের ক্রমেই দ্রুততর গতিকে সমর্থন করছে।

এ বছরের শুরুতে নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে মহাবিশ্ব আগের ধারণার চেয়ে ৮ শতাংশ দ্রুত বেগে প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু যে ডার্ক এনার্জিকে এই তীব্র প্রসারণের নায়ক মনে করা হচ্ছে, তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এখন একদল আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ বলছেন, ডার্ক এনার্জি নিয়ে চিন্তা করাই নিষ্প্রয়োজন। সম্ভবত এর কোনো অস্তিত্বই নেই। তাঁদের দাবির সপক্ষে আছে আরও বেশি পরিমাণ টাইপওয়ান সুপারনোভার তথ্য।

তাঁরা বলছেন, যে পরিসংখ্যানিক পদ্ধতিতে আগের বিশ্লেষণ পরিচালিত হয়েছিল, সেটি ১৯৩০ সালের পুরোনো পদ্ধতি। তাঁদের হাতে রয়েছে বর্তমানে বিপুল পরিমাণ সুপারনোভার তথ্য। তাই আগের পুরোনো নিয়ম প্রযোজ্য নয়। তাঁরা আরও বলছেন, কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণ যে প্রমাণ দিয়েছিল, সেটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছিল না। গবেষণা দলের প্রধান ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবির সরকার বলেছেন, ‘আমরা ৭৪০টি টাইপওয়ান সুপারনোভা নিয়ে কাজ করেছি, যা আগের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ। আমাদের উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, মহাবিশ্বের প্রসারণ দ্রুততর বেগে নয়, বরং হচ্ছে নির্দিষ্ট একটি বেগে। এটা সত্য হলে ডার্ক এনার্জির কোনো প্রয়োজন পড়বে না।’

দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কোনো ধ্রুব বেগে প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ধারণা প্রতিষ্ঠা পায় কি না। আপাতত অপেক্ষা ছাড়া কিছুই করার নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: নেচার, সায়েন্স অ্যালার্ট ডটকম ও phys.org