ইয়ংয়ের পরীক্ষা

আলো পদার্থ না শক্তি—এ প্রশ্ন বহুদিনের। আলোর পদার্থ-বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সাধারণভাবে যে বস্তুকে ধরাছোঁয়া যায়, সে বস্তু পদার্থ। পদার্থ বলপ্রয়োগে বাধা দেয়। আলোর নির্দিষ্ট আকার-আয়তন নেই। বলপ্রয়োগে বাধাও দিতে পারে না। তাই আলো পদার্থ নয়, শক্তি।

মধ্যযুগে আলো নিয়ে কাজ করেছিলেন আরবের বিজ্ঞানী ইবনে হাইসাম (আল হাজেন)। তবে এ বিষয়ে সত্যিকার অর্থে গবেষণা শুরু করেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। আগে মানুষের ধারণা ছিল, স–র্য বা নক্ষত্রের আলোর রং একটাই। সেটা হলো সাদা। অর্থাত্ সাদা আলোকে মৌলিক আলো বলেই জানত সবাই। কিন্তু নিউটনের মনে এল অন্য ভাবনা। রংধনুতে সাতটি রং কেন? রংধনু নিজে তো কোনো আলোক উত্স নয়। বাতাস ও মেঘ সূর্যের আলো ধার করে রংধনু বানায়। তাহলে রংধনু সাতটি রং পেল কোথায়? এর উত্তর খুঁজতে গিয়েই নিউটনের মনে হলো, সূর্যের সাদা আলো মৌলিক নয়। সাদা আলো হয়তো অনেক রঙের মিশ্রণ। কোনো একটা উপায়ে যদি একে ভাঙা যায়...। প্রিজম ব্যবহার করে নিউটন সাদা আলোকে ভাঙতে সক্ষম হলেন। এ জন্য তাঁকে একটা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।

১৬৬৫ সাল। নিউটন দেখলেন, প্রিজমের ভেতর দিয়ে আসা সাদা আলোকরশ্মি পর্দায় পড়েছে সাত রঙে ভাগ হয়ে। রংধনুতে যেভাবে সাতটি রং পরপর সাজানো থাকে, সেভাবেই পর্দার ওপর সাত রঙের পট্টি তৈরি হয়েছে। রংগুলোর সজ্জাটাও রংধনুর মতো। প্রথমে বেগুনি। তারপর নীল। এরপর একে একে আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল পরপর সাজানো।

নিউটন ভাবলেন, সাদা আলো কেন এভাবে ভাঙল? আলোকরশ্মি শুধু রশ্মি নয়। কণার সমষ্টি। আলো যে কণা, এর পক্ষে বড় প্রমাণ আলো সোজা পথে চলে। ওদিকে নিউটনের সমসাময়িক বিজ্ঞানী ওলে ক্রিস্টেনসন রোমার আলোর গতি মাপেন।

নিউটন তখন আলোর কণা-ধর্ম সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হন। কণা বলেই আলোর গতি নিদিষ্ট মনে করতেন নিউটন।

১৬৭৮ সাল। ডাচ বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস বললেন, আলো আসলে একধরনের তরঙ্গ। আলোর উত্স থেকে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। তরঙ্গতত্ত্বের ত্রুটি ছিল কিছু। কিন্তু সাফল্যও তো কম নয়। তরঙ্গতত্ত্ব দিয়ে একই সঙ্গে আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ, অপবর্তন, ব্যতিচার ব্যাখ্যা করা যায়। তবে নিউটন তরঙ্গতত্ত্বের ঘোর বিরোধী ছিলেন। বৈজ্ঞানিক সমাজে তখন নিউটনের ব্যাপক প্রভাব। সবাই তাঁকে ভয় করে চলতেন। নিউটনের কণাতত্ত্বের প্রভাবে তাই হাইগেনসের তরঙ্গতত্ত্ব চাপা পড়ে যায়।

১২৩ বছর পর ছাইচাপা তরঙ্গতত্ত্বকে আবার আলোর মুখ দেখান ব্রিটিশ পদার্থবিদ থমাস ইয়াং। আলো তরঙ্গ, এ কথা প্রমাণের জন্য একটা পরীক্ষা চালিয়েছিলেন ইয়াং। সেটা দুনিয়াজুড়ে বিখ্যাত ‘ইয়াংস ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট’ নামে। ইয়াংই কিন্তু এই পরীক্ষার জনক নন। কেমন ছিল সেই পরীক্ষাটা দেখে নেওয়া যাক। একটা ঘর। পুরোপুরি অন্ধকার। ডার্করুম যাকে বলে আরকি। সেই ঘরের ভেতর আরেকটা ঘর। এই ঘরটা ধরা যাক মসৃণ কাঠবোর্ড দিয়ে তৈরি। কাঠবোর্ডের দেয়ালে পাশাপাশি দুটো ছিদ্র করলেন ইয়াং। মেঝে থেকে একটু উঁচুতে।

ছবি ১
ছবি ১

তারপর দেয়ালের বাইরের দিকে একটা টেবিল রাখা যাক। টেবিলের ওপর রাখা যাক একটা মোমবাতি। মোমবাতির শিখা ও ছিদ্র দুটো একই উচ্চতায় থাকবে। তবে কোনো একটা ছিদ্রের সোজাসুজি রাখলে চলবে না মোমবাতিকে। রাখতে হবে দুই ছিদ্রের মাঝামাঝি। এতে আলো দুই ছিদ্রের ওপর পড়বে সমানভাবে। দুই ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করা আলোকরশ্মি গিয়ে পড়বে কাঠের ঘরটার ভেতরে। ঠিক বিপরীত দিকের দেয়ালে। এই দেয়ালটা সাদা রঙের হলে ভালো হয়। পর্দার মতো কাজ করে তাহলে। দুই ছিদ্র দিয়ে আলোকরশ্মি গিয়ে পড়বে সেই পর্দায়। পর্দায় পড়া আলোকরশ্মি দুটির চেহারা কেমন হবে?

ছবি ২
ছবি ২

মোক্ষম প্রশ্ন। এ প্রশ্নের যে জবাব পেলেন ইয়াং, তা আলোকবিজ্ঞানকে ওলটপালট করে দিল। আলো যদি কণা হতো তাহলে রশ্মি দুটো ছিদ্র দিয়ে চলে যেত সরলরেখায়। কোনো কোণে বেঁকে যেত না। সোজা গিয়ে পড়ত সামনের দেয়ালে বা পর্দায়। পর্দায় দুটো আলোকবিন্দু তৈরি করত। ছবিটা হতো ১ নং ছবির মতো। কিন্তু ইয়াং যে ফল পেলেন তা মোটেও ওই ছবির মতো নয়। দেখলেন ছিদ্র দিয়ে ঢোকা আলোকরশ্মি পর্দার ওপরে শুধু দুটো উজ্জ্বল বিন্দুই তৈরি করেনি, প্রতিটি উজ্জ্বল বিন্দুর পাশে একটা করে অন্ধকার বিন্দুও তৈরি হয়েছে। আবার অন্ধকার বিন্দুর পাশে একটা করে উজ্জ্বল বিন্দু তৈরি করেছে। ২ নম্বর ছবির মতো।

ছবিটা দেখে মনে হয়, আলোকরশ্মিগুলো ছিদ্র দিয়ে আসছে না। আসছে দুই ছিদ্রের ঠিক মধ্যবিন্দু দিয়ে। অথচ সেই মধ্যবিন্দুতে কোনো ছিদ্রই নেই। এভাবে পর্দার ওপর বেশ কিছু উজ্জ্বল ও অন্ধকার বিন্দুর পট্টি তৈরি হয়। সেই পর্দাটাকে ঘুরিয়ে সুবিধামতো করে দেখা যাক। পর্দায় পাশাপাশি পাঁচটা উজ্জ্বল আলোক বিন্দু দেখা যাচ্ছে। দুটো উজ্জ্বল বিন্দুর মাঝখানের অংশে একটা করে অন্ধকার বিন্দু আছে। পুরো ঘরটাই অন্ধকার। অন্ধকার পর্দা বা দেয়ালটাও। তাই উজ্জ্বল বিন্দুগুলোর মাঝখানে অন্ধকার বিন্দুগুলো আলাদাভাবে দেখা যাওয়ার কথা নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইয়াং এই ফল কেন পেলেন? আলো যদি কণা হতো পর্দায় শুধু দুটো ছবি দেখা দিত। ১ নম্বর ছবির মতো। তার মানে আলো কণা নয়। আলোকে তরঙ্গ ধরলেই কেবল এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ ইয়াং সিদ্ধান্ত এলেন আলো আসলে তরঙ্গই।

বিংশ শতাব্দীতে এসে আলোর কণাতত্ত্ব আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলেন আইনস্টাইন। তিনি আলোর কণার নাম দিলেন ফোটন। তবে নিউটনের আলোর কণার সঙ্গে একালের ফোটনের চরিত্রগত কোনো মিলই নেই। কণাতত্ত্ব ফিরে এসেছে। কিন্তু তরঙ্গতত্ত্বও হারিয়ে যায়নি। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে হাত ধরাধরি করে চলছে আলোর কণা ও তরঙ্গতত্ত্ব।

 সূত্র : নেচার