অমৃতের সন্ধানে

মানুষ কত বছর বাঁচে? প্রশ্নটা সহজ নয়, কেননা নানা লোককাহিনিতে হাজার বছর বয়সী মানুষের কথাও পাই। কিন্তু চারপাশে তাকালে শতবর্ষী মানুষও খুব একটা দেখি না। এমনকি অনেকেরই ধারণা, প্রাচীনকালে মানুষ অনেক বেশি বাঁচত। তবে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে সে কথারও সত্যতা মেলে না। বরং আমরা দেখি, মধ্যযুগে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩০-৪০ বছর। এমনকি মাত্র ১০০ বছর আগেও পুরো বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩১ বছর। সেটাই এ যুগে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০-৭০ বছরে। এক শতক আগের ইতিহাস পড়লেও জানা যায়, মানুষ ৪০ বছরেই কেমন বুড়িয়ে যেত। গড় আয়ু উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ার মূল কারণ, চিকিত্সাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব ত্বরিত উন্নয়ন। গত ৫০ বছরে চিকিত্সাশাস্ত্র যতটা বিকশিত হয়েছে, তার সিকি ভাগ গত হাজার বছরেও হয়নি। নানা মহামারি, প্লেগ, কলেরাসহ নানা রোগে একসময় লাখো মানুষ মারা যেত। সেসব এখন নির্মূল হয়েছে। তবে চিকিত্সা ব্যয়বহুল সেবা। তাই উন্নত দেশে মানুষের আয়ু যত, অনুন্নত দেশে তার চেয়ে কম।

প্রাণীর সাবালক হওয়ার সঙ্গে বয়সের একটা সম্পর্ক আছে। যে প্রাণী সাবালক হতে বেশি সময় নেয়, তারা বাঁচেও বেশি। মানুষ সাবালক হয় ১৮-২০ বছরে, বাঁচে ৭০-৮০ বছর। অন্যান্য প্রাণী পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সাবালক হওয়ার সময়ের সাত-আট গুণ বেশি সময় বাঁচে প্রাণীরা। সে হিসাবে মানুষের অন্তত দেড় শ বছর অনায়াসে বাঁচার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১২২ বছরের বেশি বয়সী কোনো মানুষের সন্ধান মেলেনি।

এই বয়স আর যৌবনকে কীভাবে বাড়িয়ে নেওয়া যায়, কীভাবে জরাকে রুখে দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে ভাবনা আর নানা উদ্যোগ প্রাচীনকাল থেকে এখন অবধি বজায় রয়েছে। শুধু আমেরিকায় প্রতিবছর ১৫ বিলিয়ন ডলারের অ্যান্টি-এজিং প্রোডাক্ট বিকিকিনি হয়। লোককথায় আমরা পাই, দেবতারা অমর, মৃত্যু ও জরা তাদের স্পর্শ করে না। অমরত্ব তাই দেবগুণ। কিন্তু কালে কালে সেই আরাধ্য যৌবন পেতে পরাক্রমশালী সম্রাট, শাসকেরা কম চেষ্টা করেননি। বহু খোরপোষ দিয়ে বাদশাহরা নিজেদের অ্যালকেমিস্ট রাখতেন, যাতে তাঁরা পরশপাথর বানাতে পারেন। সেই পরশপাথরের স্পর্শে লোহাকে সোনাই বানাবে না, তার স্পর্শে মানুষও অমর হয়ে উঠবে। সে রকম বিশ্বাস তাঁদের ছিল। মধ্যযুগে ইউরোপেও বহু লোক ফাউন্টেন অব ইয়ুথ খুঁজেছে হন্যে হয়ে। কিংবদন্তি ছিল, এ ঝরনার পানিতে অবগাহন করলে মৃত্যু স্পর্শ করবে না। চীনের কিন রাজবংশের পরাক্রমশালী সম্রাট শি হাং অমৃত পানীয়র খোঁজে তাঁর অ্যালকেমিস্ট জু ফুকে পাঠিয়েছিলেন পূর্ব সাগরে। তার সঙ্গে দিয়েছিলেন ৫০০ নারী আর ৫০০ পুরুষের বিশাল বহর। কথিত আছে, অমৃতের সন্ধান করতে গিয়ে তারা আর ফিরে আসেনি। তারাই জাপান দেশটি গঠন করেছিল বলে ধারণা করা হয়।

তবে এই অমরত্বের সন্ধান আধুনিক বিজ্ঞানময় জগতে একইভাবে না হলেও কম জোরেশোরে হচ্ছে না। লাইফ এক্সটেনশন ফাউন্ডেশনের মতো শত শত সংগঠন রাতদিন বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা করছে কীভাবে জীবনটাকে আরেকটু দীর্ঘ করে নেওয়া যায়, কীভাবে বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখা যায়। বিজ্ঞান দিয়ে মানুষ জয় করেছে অনেক কিছু। এই জরা ও স্বল্প আয়ুও সে জয় করতে পারবে, সেটা অনেক ভবিষ্যত্দ্রষ্টাই মনে করেন। কী হতে পারে সেসব পদক্ষেপ, যাতে দীর্ঘ যৌবনের অধিকারী হয়ে উঠবে মানুষ? প্রকৃতিতে যেসব প্রাণী অনেক বছর বাঁচে তারাইবা কীভাবে বাঁচে, সে রহস্যও উদ্ধারের কাজে তাঁরা নিয়োজিত। তাঁরা দেখেছেন, মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাঁচে গভীর জলের এক হাঙর (গ্রিনল্যান্ড শার্ক)। ধারণা করা যায়, এরা ৫০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

ইতিমধ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়ে বিজ্ঞানীরা ভাবছেন তার মধ্যে আছে স্টেম সেল নিয়ে কাজ করা, টিস্যুর নবায়ন, মলিক্যুলার রিপেয়ার, জিনথেরাপি, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন। আমাদের দেহের ত্বক ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ পুনরায় গঠিত হয় না। প্রাণিজগতে কিন্তু এ ঘটনা বিরল নয়। স্যালাম্যান্ডারের পা কাটা পড়লে নতুন পা গজায়, নতুন রেটিনা গজায় এমনকি পরিপাকতন্ত্র, চোখের লেন্সও নতুন করে তৈরি হতে পারে। এটা অবশ্য বিরল উদাহরণ। মানুষেরও অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে হয়, যদিও সব অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যায় না। যকৃতের একটা অংশ ফেলে দিলে সেটা ভরাট হয়ে যায়। কিন্তু অন্য অঙ্গের এমন গুণ নেই। তাই মানুষকে ভরসা করতে হয় কারও দানকৃত অঙ্গের জন্য। কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটা প্রতিস্থাপন করে মানুষ দৃষ্টি ফিরে পেতে পারে। তবে আমাদের দেহ খুব সহজে অন্যের কিছু গ্রহণ করে না। একবার যদি বুঝতে পারে প্রতিস্থাপিত অঙ্গটি তার নিজের নয়, তাহলে দেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিদ্রোহ করে সেটা অস্বীকার করে। সে কারণে সফল অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রায়ই ব্যর্থ হয়। প্রসঙ্গত, স্মরণ করা যেতে পারে মাইকেল ব্যে পরিচালিত দ্য আইল্যান্ড সায়েন্স ফিকশন সিনেমার কথা। সেখানে ধনীরা তাদের একটি ক্লোনকে একটা বিচ্ছিন্ন জায়গায় লালন করে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো প্রয়োজনে তাদের ক্লোন থেকে প্রয়োজনীয় অঙ্গটি নিয়ে আরও বেশি দিন বাঁচা যায়। একই রকম আইডিয়ার আরেকটি কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস আছে, জাপানি লেখক কাজুও ইশিগুরোর নেভার লেট মি গো। এতে দেখা যায়, একদল ছেলেমেয়েকে বড় করা হয় ভবিষ্যতে অন্যদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সরবরাহ করার জন্য। নীতিগতভাবে খুবই নির্মম মনে হয় এসব ব্যবস্থা। কিন্তু মানুষের বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটাবে না বা এখনই ঘটছে না, তা কে জানে!

জরা হটানোর আরেকটি উপায় হতে পারে দেহের টিস্যুকে বুড়িয়ে যাওয়া থেকে ঠেকানো। আমাদের দেহের কোষগুলো জরাগ্রস্ত হয়ে যায় কেন সেটা একসময় রহস্য ছিল। কিছু প্রাণী তাদের কোষগুলো অনবরত নবায়ন করতে পারে। তাই কখনোই বুড়ো হয়ে মরে না। ভূমধ্যসাগরীয় একধরনের জেলিফিশ প্রজাতি রয়েছে, যেগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধাবস্থা থেকে শৈশবে ফিরে যেতে পারে। মানুষের কোষগুলোকে একসময় ভাবা হতো যত খুশি বিভাজনে সক্ষম। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেলে হয়তো সে কোষ দিয়ে গঠিত অঙ্গটি চিরনবীন থেকে যাবে। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়, আমাদের কোষগুলো বড়জোর ৬০-৭০ বার বিভাজিত হতে পারে। অ্যানাটমিস্ট লিওনার্ড হ্যেফ্লি এটা প্রথম প্রমাণ করেন। তাই এই বিভাজনসীমা হ্যেফ্লিক লিমিট নামে পরিচিত। তিনি দেখেন, প্রতিবার বিভাজনের পর নতুন কোষগুলোর ডিএনএর একটি অংশ টেলোমিয়ার আগের চেয়ে আরেকটু ছোট হয়। বিভাজিত হতে হতে এ টেলোমিয়ার একসময় এত ছোট হয় যে নতুন করে সেই কোষ আর বিভাজিত হতে পারে না। তাই পুষ্টি উপাদান পেলেও সে কোষকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না। কিছু কোষ হ্যেফ্লিক লিমিট অতিক্রম করতে পারে। সহজ উদাহরণ ক্যানসার কোষ। ক্যানসার কোষ যে অবিরত সর্বগ্রাসীরূপে বাড়তেই থাকে তার কারণ, টেলোমারেজ নামে এক এনজাইম ওই কোষের টেলোমিয়ারকে ছোট হতে দেয় না। হেলা সেল নামে ল্যাবরেটরিতে একধরনের চিরঞ্জীব কোষ দেখতে পাওয়া যায়। এটি হেনরিয়েটা ল্যাকস নামে কৃষ্ণাঙ্গ এক নারীর শরীর থেকে ১৯৫১ সালে নেওয়া হয়েছিল। এখনো সে কোষ সারা পৃথিবীর গবেষণাগারগুলোতে বেঁচে আছে। খুব সম্প্রতি রেবেকা স্কুলট নামের এক লেখিকা দ্য ইমমরটাল লাইফ অব হেনরিয়েটা ল্যাকস নামে একটা বই লিখেছেন। তাতে তিনি জানিয়েছেন, যে যুক্তরাষ্ট্র ব্যক্তিগত গোপনীয়তার এত বড়াই করে, তারাই ওই নারী বা তাঁর পরিবার থেকে অনুমতি না নিয়েই তাঁর কোষ নানা গবেষণাগারে পাঠিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন ভাবছেন, এই টেলোমারেজ এনজাইমকে সুস্থ কোষে ব্যবহার করা গেলে হয়তো বার্ধ্যকের কারণে কোষের মৃত্যু হবে না। আর নিয়ন্ত্রিতভাবে সেটা করতে পারলে আয়ু বাড়ানো যাবে অনেক গুণে।

আধুনিক জিন গবেষক রিচার্ড ডকিন্স তাঁর বই দ্য সেলফিশ জিন-এ আয়ু বর্ধিত করার একটা সম্ভাব্য উপায় বলেছেন। সেটা হলো দেহের জিনদের ধোঁকা দেওয়া। আমাদের জীবনের পুরো সময় ধরেই নানা জিন সক্রিয় হয়। শেষ জীবনে যেসব জিন সক্রিয় হয়, সেগুলোই মূলত বার্ধক্যকে ত্বরান্বিত করে। তাই আমরা যদি সেই জিনগুলো সক্রিয় হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ রুখতে পারি, তাহলে জিনগুলো কখনোই সক্রিয় হবে না। সেটা সম্ভব হলে বার্ধক্যকে অনেক অনেক বছর পিছিয়ে দেওয়া যাবে।

এভাবে নিরন্তর গবেষণা আর প্রচেষ্টা চলতে থাকলে মানুষ অমরত্বকে একদিন অর্জন করে নিতে পারবে, সেটা আজ অনেকের বিশ্বাস। অন্তত আয়ু কয়েক গুণ বাড়াতে পারবে নিকট ভবিষ্যতেই। গত ১০০ বছরেই বিজ্ঞানের উন্নতিতে গড় আয়ু বেড়েছে অন্তত ৩০ বছর। এ শতকে সে হিসাবে ২০০-৩০০ বছর বাঁচার উপায় মানুষ খুঁজে পাবে, সেটা খুব বড় আশা নয়। কিন্তু তারপরও অনেকের ধারণা, এভাবে দীর্ঘায়ু অর্জন প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ। ইতিমধ্যে মানুষ তার নিকটতম প্রাইমেটের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ বাঁচে। আবার এই আয়ুই সহ্য করতে পারছে না কত কত মানুষ। বেঁচে থাকার মানে খুঁজে ফিরে ব্যর্থ হয়ে তারা জীবনকে শেষ করে দিতে দ্বিধা করে না। প্রতিবছর যুদ্ধবিগ্রহ আর দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায়, তার অনেক গুণ বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে।

জীবনের সীমা এটুকু বলেই হয়তো জীবন সুন্দর, সেটা আরও দীর্ঘ হলে ক্লান্তি আর বিষণ্নতাই হয়তো মানুষের সঙ্গী হয়ে উঠবে। তারপরও মানুষ প্রকৃতিকে ক্রমাগত জয় করবে, এটাই বিজ্ঞানের নিয়ম। সেই নিয়মে আমাদের হাতে একসময় অমৃত সুধা ধরা দেবে, সেটা আশা করাই যায়।

লেখক: গবেষণা চিকিত্সক, জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি