মানুষ কী করে গুনতে শিখল

দিকালের মানুষ সংখ্যা কী, জানত না। ভাষাই ছিল না, তো সংখ্যা। তারা পশু শিকার করত। করত পশুপালনও। গুনতে জানে না, পশুর হিসাব রাখবে কী করে! সুতরাং গণনা শিখতে হবে। কীভাবে? পাথরে কিংবা পুরোনো কাঠের গায়ে দাগ কেটে কেটে। সেভাবে আর কদ্দিন চলে? ধরুন, হারিয়ে গেল সেই পাথর, কিংবা পুরোনো কাঠ। তখন সব হিসাব বরবাদ। সুতরাং, সংখ্যা আবিষ্কার করতে হবে। হলো আবিষ্কার। তবে মোটে দুটো। দুটো সংখ্যা দিয়ে কীভাবে চলবে?

তারপর একদিন বাধল দুই পণ্ডিতের লড়াই। যিনি সবচেয়ে বেশি সংখ্যা বলতে পারবেন, জিতবেন তিনিই। একজন জিতলেন। বেড়ে গেল তাঁর খ্যাতি। কত পর্যন্ত বলেছিলেন তিনি? মাত্র ৩ পর্যন্ত। ৩-এর পরে কী হয়, মানুষ জানে না। তাই তার নাম দিল অনেক। ৪ হলেও অনেক, ১২ হলেও অনেক। তাদের কাছে ৪-ও যা ৪ লাখও তা।

তখন মানুষ থাকত ছোট ছোট দলে। ছোট ছোট সংখ্যা হলেই তাদের চলে যায়। তাই বড় সংখ্যার দরকার হয় না। আবার হয়ও। একেকজনের অনেকগুলো ছেলেমেয়ে হতো সে যুগে। তাদের এক-আধজন যদি হারিয়ে যায়, বুঝবে কী করে? সুতরাং, সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। কীভাবে? লিখতে তো তারা জানে না। নেই কোনো লিপিও। তাহলে? হাতের আঙুল আছে না? একটা আঙুল একটা সংখ্যা। কিন্তু টুকে রাখার দরকার হয় যদি? তাহলে ছবি আঁকতে হবে। হাতের কিংবা আঙুলের। একটা আঙুল মানে ১। একটা হাতের ছবি মানে ৫। কারণ পাঁচ আঙুল আছে হাতে। কিন্তু বড় বড় সংখ্যা এলেই কুপোকাত! সে সমাধানও এল। হাতের আঙুল, পুরো হাত; এগুলোর সঙ্গে আরও কিছু ছবি যোগ করে হিসাব রাখা হলো বড় সংখ্যার। আজগুবি মনে হচ্ছে? প্রাচীন মিসরের একটা হিসাব পাওয়া গেছে। সাত-আট হাজার বছরের পুরোনো। যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক রাজা বিজয়ী রাজাকে উপহার পাঠিয়েছেন। গরু, ছাগল, মানুষ ইত্যাদি। তারই হিসাব রয়েছে প্যাপিরাসের বাকলে। হিসাবগুলো আছে ছবি আকারে। সেই খতিয়ানে ছাগলের সংখ্যা কত, জানেন। ১৪ লাখেরও বেশি। শুধু কয়েকটা ছবি এঁকেই এতগুলো ছাগলের হিসাব দেওয়া হয়েছে, ভাবা যায়!

ধীরে ধীরে মানুষ আরও পরিচ্ছন্ন সংখ্যা আবিষ্কার করল। গ্রিসে, চীনে, মধ্যপ্রাচ্যে, ভারতে। সেগুলোর কোনোটাই আজকের সংখ্যার মতো নয়। ১০টি সংখ্যাও আবিষ্কৃত হলো। বুঝল না কেবল শূন্যের কদর। আর্কিমিডিস, পিথাগোরাস, ইউক্লিডের মতো জগদ্বিখ্যাত গণিতবিদেরাও শূন্যের ব্যবহার জানতেন না। ১০১ লিখতে দুটো একের মাঝখানে শূন্য লাগে। এর চেয়ে বড় অনেক সংখ্যাতেই মাঝখানে দরকার হয় শূন্যের। শূন্যই যদি না থাকে, ১০১ আর ১১-এর মধ্যে তফাত কিসের?

সেই শূন্য আবিষ্কার করলেন আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের এক গণিতবিদ। সে গল্প বলে মজা নষ্ট করব না। তার চেয়ে বরং মানুষকীভাবে গুনতে শিখল বইটা পড়ে ফেলুন। একটা জায়গায় ইউক্লিডের গল্প বলা হয়েছে বইটিতে: ‘একদিন এক ছাত্র ইউক্লিডের কাছে জ্যামিতির প্রথম প্রতিজ্ঞাটি শিখে তাঁকে প্রশ্ন করল, স্যার, জ্যামিতির প্রথম প্রতিজ্ঞাটি শিখে কী লাভ হলো, বলতে পারেন?’ ইউক্লিড রসিক লোক ছিলেন। তিনি চাকরকে ডেকে বললেন: ‘ওহে, এই ছাত্রটিকে তুমি গোটা কয়েক পয়সা দাও দিকিনি। তাহলেই বুঝতে পারবে, জ্যামিতির প্রথম প্রতিজ্ঞাটি শিখে কী লাভ হলো ওর।’ এমন মজার মজার গল্প আছে এই বইতে।

ভাস্কর আচার্য তাঁর পাটিগণিতের বইটির নাম দিয়েছিলেন লীলাবতী। সে গল্পও আমাদের নিয়ে যায় পুরোনো দিনের আজব জগতে।

খুব সহজ ভাষায় গণনা, সংখ্যা আর অঙ্কের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। এত মজাদার গণিতের বই বাংলা ভাষায় বোধ হয় আর নেই। ১৯৬৭ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি থেকে। সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে বইটি। বইটি সারা দেশে বইয়ের দোকানগুলোতে পাওয়া যায়। ৮৮ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য মাত্র ১৯০ টাকা।