গ্রহের সূত্র এবং কেপলার

একটানা কয়েক রাত রাতের আকাশের দিকে নজর রাখলে দারুণ একটি ব্যাপার আপনার চোখে পড়বে। দেখবেন, প্রতি রাতেই তারারা একটু একটু করে পশ্চিমে সরে যাচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট রাতে তো সরে অবশ্যই। এ ছাড়া একটি তারা প্রতি রাতে আগের রাতের প্রায় চার মিনিট আগেই একই অবস্থানে চলে আসে। এক বছর পর একে ঠিক আগের সময়ে আগের জায়গায় দেখা যায়। কিন্তু গ্রহরা এই নিয়ম মানে না। দূরের তারাদের তুলনায় কখনো এরা বেশি পশ্চিমে চলে যায়। কখনো আবার পরের রাতে দেখা যায়—এরা আগের চেয়ে পূর্ব দিকে চলে এসেছে। প্রাচীনকালে গ্রহদের এই আচরণ ছিল ব্যাখ্যাতীত। অ্যারিস্টটলীয় মতবাদ অনুসারে, পৃথিবী ছিল মহাবিশ্বের কেন্দ্রে। এ ধারণার ভিত্তিতে গ্রহদের গতির ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য টলেমি প্রস্তাব করলেন দূরের তারাদের পাশাপাশি গ্রহরাও পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। তবে এরা তার পাশাপাশি নিজেরা আবার একটি বৃত্তপথে ঘুরছে। এই পথের নাম ছিল মন্দবৃত্ত ।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই মডেল সঠিক হলে কখনো কখনো চাঁদকে দ্বিগুণ কাছে দেখা যাওয়ার কথা। তার মানে ভুল আছে এতে। কিন্তু ভুলটি ঠিক কোথায়? আর সঠিক মডেলটিই বা কী?

সেই গ্রিকদের আমলেই অ্যারিস্টার্কাসসহ অনেকে পৃথিবীর বদলে সূর্যকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে চিন্তা করতেন। ১৫৪৩ সালে কোপার্নিকাস এই মতবাদকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসেন। এর আগে আরবের জ্যোতির্বিদদের কেউ কেউও কাছাকাছি ধারণা প্রস্তাব করেন। যেমন আবু সাঈদ আল সিজ্জি বলেন, আকাশের তারাদের চলাচলের কারণ আসলে পৃথিবীর নিজ অক্ষের সাপেক্ষে ঘূর্ণন।

কিন্তু সঠিক জ্ঞান জানতে হলে চাই পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া তথ্য। কাজটি নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নিলেন টাইকো ব্রাহে। এই জ্যোতির্বিদ ১৫৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন ডেনমার্কে। তাঁকে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার প্রথম সক্ষম চিন্তাবিদ বলা হয়। রাতের পর রাত অমানুষিক পরিশ্রম করে তিনি যে পর্যবেক্ষণগুলো জড়ো করলেন, তা প্রচলিত তথ্যের চেয়ে ছিল পাঁচ গুণ সঠিক। তখনো কিন্তু টেলিস্কোপেরও প্রচলন হয়নি। টেলিস্কোপ ছাড়া কাজ করা উল্লেখযোগ্য জ্যোতির্বিদদের মধ্যেও তিনিই সর্বশেষ। তবু তাঁর পর্যবেক্ষণগুলো একদিকে যেমন ছিল নির্ভুল, তেমনি পরিমাণেও ছিল বিশাল।

কোপার্নিকাসের মডেলের জ্যামিতিক সুবিধা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পারেন, চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। গ্রহরা ঘুরছে সূর্যের চারদিকে। তবে তিনি ভুল করে মনে করে বসেন যে সূর্য ঘুরছে পৃথিবীর চারদিকে। অর্থাৎ, তিনি কোপার্নিকান মডেলের সঙ্গে পুরোপুরি একমত ছিলেন না। কেপলারসহ অন্যান্য কোপার্নিকান জ্যোতির্বিদেরা তাঁকে সৌরকেন্দ্রিক মডেল মেনে নেওয়ার জন্য বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ভুল ধারণা নিয়েই ১৬০১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

কেপলারের জন্ম ১৫৭১ সালে, জার্মানিতে। ক্যারিয়ারের উলে–খযোগ্য সময় তিনি গণিতের শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ১৬০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে টাইকোর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। এ সময়ই প্রাগ শহরে টাইকো দুজন সহকারীকে নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী পর্যবেক্ষণগুলো সংগ্রহ করছিলেন। পরের দুই মাস তিনি টাইকোর বাড়িতে বেড়ালেন। চিন্তাভাবনা করলেন মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে পাওয়া তথ্যগুলো। প্রথম দিকে টাইকো নিজের উপাত্তগুলো খুব সযত্নে লুকিয়ে রাখতেন। কিন্তু কেপলারের তাত্ত্বিক জ্ঞান তাঁকে যথেষ্ট মুগ্ধ করে। ফলে কেপলার আগের চেয়ে বেশি তথ্য নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ পেলেন।

হঠাত্ করে টাইকোর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেল কেপলারের। শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক আবার জোড়া লাগল। পরিবার নিয়ে ফিরে আসার জন্য বাড়ি এসে বিভিন্ন কারণে আর সঙ্গে সঙ্গে ফিরতে পারলেন না। সেটা জুন মাসের কথা। শেষ পর্যন্ত আগস্টে ফিরে এলেন টাইকো ব্রাহের কাছে। একত্রে কাজ শুরু হলো পুরোদমে। ১৬০১ সালের অক্টোবরে আকস্মিকভাবে টাইকোর মৃত্যু হলে তাঁর অসমাপ্ত কাজের ভার পড়ে কেপলারের ওপর।

দীর্ঘদিন সাধনা করে ১৬০৯ সালে তিনি গ্রহের গতির প্রথম দুটি সূত্র এবং ১৬১৯ সালে তৃতীয় সূত্র প্রকাশ করেন। প্রথম সূত্র থেকেই জানা গেল, গ্রহরা সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে। সূর্যের চারদিকে গ্রহদের ঘোরার বিষয়টি প্রমাণিত হলেও আরও বহুদিন যাবৎ সূর্যকে পুরো মহাবিশ্বের কেন্দ্র ভাবা হতো। আঠারো শতকে এসে ধারণা তৈরি হলো না, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রই হয়তো মহাবিশ্বের কেন্দ্র। আর এখন? এখন আমরা জানি, মহাবিশ্বের কেন্দ্রই নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: বিবিসি ফিউচার ও উইকিপিডিয়া