মহাজাগতিক সভ্যতায় আমাদের অবস্থান কোথায়

পৃথিবীতে প্রজাতির সংখ্যা অনেকের মতে, কয়েক লাখ। আবার কারও মতে, কয়েক কোটি। প্রজাতির সংখ্যা যা-ই হোক, মানুষ যে সবচেয়ে উন্নত প্রজাতি, এতে কোনো ভুল নেই। হ্যাঁ, এই দাবির পেছনে যথেষ্ট সত্যতাও রয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরে ভবিষ্যতের দিকে যে যাত্রা, তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে! এর আংশিক উত্তর লুকিয়ে আছে প্রজাতি হিসেবে আমাদের পরমায়ু কত দিন, তার ওপর। কারণ, পৃথিবীতে প্রাণের ইতিহাস আসলে বিলুপ্তির ইতিহাস। এর আগে পৃথিবীতে কয়েকবার গণবিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। আজ আমরা অনেক অগ্রসর হলেও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে আছি। তাই সভ্যতার মানদণ্ডে কতটা অগ্রসর হয়েছি, সামনের দিনগুলোতে আরও কতটা অগ্রসর হব, তা নির্ভর করছে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচার ওপর।

মার্কিন জ্যোতির্বিদ কার্ল সাগান একবার বলেছিলেন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির দিক দিয়ে মানব সম্প্রদায় এখন কৈশোর পার করছে। তবে বার্ধক্যে পৌঁছাতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে আমাদের অর্জিত জ্ঞান কতটা প্রজ্ঞার সঙ্গে ব্যবহার করছি, তার ওপর। কেননা, আমাদের হাতে এখনো যে পরিমাণ পারমাণবিক বোমার মজুত রয়েছে, তা দিয়ে আমরা মুহূর্তের মধ্যে নিজেদের ধ্বংস করে ফেলতে পারি। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগেও আমাদের অনিবার্য ধ্বংস ঘনিয়ে আসতে পারে। কারণ, সেই অনিবার্য ধ্বংস থেকে বাঁচাতে পারে, এমন প্রযুক্তি এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই।

শুধু কার্ল সাগানই নন, অন্য বিজ্ঞানীরাও বিভিন্নভাবে আমরা কত দূর এগিয়ে গেছি, তার পরিমাপ করার চেষ্টা করেছেন। এ কাজে তাঁরা কারদাশেভ স্কেল ব্যবহার করেছেন। একটি সভ্যতা কতটা জ্বালানি ব্যবহার করে, তার ভিত্তিতে অগ্রগতি মাপা হয়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে রাশিয়ান মহাকাশবিজ্ঞানী নিকোলাই কারদাশেভ মহাজাগতিক সভ্যতার স্কেল প্রস্তাব করেন। তাঁর প্রস্তাবে জ্বালানি সামর্থ্যের ভিত্তিতে তিন ধরনের মহাজাগতিক সভ্যতা রয়েছে।

টাইপ ওয়ান সভ্যতার বাসিন্দারা গ্রহের সব জ্বালানি ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আবার এই জ্বালানি ব্যবহার করে তাদের সূর্য থেকে আপন গ্রহে যেতে পারবে। মানবসভ্যতা টাইপ ওয়ানে রূপান্তরিত হতে পারবে, যদি সৌরজগৎ থেকে পৃথিবীতে আসা সব জ্বালানি আমরা ব্যবহার করতে সক্ষম হই। অথবা যদি আমরা এই পরিমাণ শক্তি উত্পন্ন ও ব্যবহার করতে পারি।

ধারণা করা হয়, বর্তমানে আমরা ৭৫ শতাংশের মতো জ্বালানি ব্যবহার করছি। তাই আমরা এখনো টাইপ ওয়ান সভ্যতায় রূপান্তরিত হতে পারিনি। এদিকে কারদাশেভ তাঁর স্কেলে টাইপ জিরো সভ্যতা বলে কিছু রাখেননি। তবে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী, শক্তি খরচ করার দিক দিয়ে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে আমরা টাইপ ওয়ান সভ্যতায় পৌঁছাতে পারব।

মহাজাগতিক সভ্যতার পরিমাপে অন্য ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে জ্বালানির ব্যবহার একটু গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর এবং গাইডলাইনও বটে। টাইপ ওয়ান সভ্যতা যে পরিমাণ জ্বালানি খরচ করে, আমরা সে পথেই এগোচ্ছি। অন্যদিকে গ্রহের জ্বালানিব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ মানে হলো বায়ুমণ্ডল, ভূত্বক, আবরণ, কেন্দ্রের মতো গ্রহের অন্যান্য শক্তির ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। টাইপ ওয়ান সভ্যতা আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, জলবায়ুকে প্রভাবিত করতে পারবে, ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে। তারা আন্তঃগ্রহ ভ্রমণ করতে পারবে।

টাইপ ওয়ানের পরের ধাপ হলো টাইপ টু সভ্যতা। এই সভ্যতা নিজের নক্ষত্রের জ্বালানিও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এর ফলে টাইপ ওয়ান সভ্যতা থেকে কয়েক কোটি পরিমাণ বেশি মাত্রায় জ্বালানি ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। তারা নক্ষত্রের বাইরেও গ্রহের সোলার প্যানেল, উপগ্রহ ও মহাশূন্য থেকেও সংগ্রহ করতে পারবে।

তারা আরও বেশি যাযাবর জীবনের অধিকারী হবে। আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণ তাদের জন্য ডাল-ভাত হয়ে যাবে। এর ফলে তারা দূরের কোনো গ্রহে গিয়েও কলোনি বানাতে পারবে। সুপারনোভা কিংবা অন্য যেকোনো দুর্ঘটনা, যা পুরো সোলার সিস্টেম ধ্বংস করে দিতে পারে, সেসব দুর্ঘটনা থেকেও নিজেদের বাঁচাতে পারবে। তা ছাড়া তারা নক্ষত্র তৈরি করতে পারবে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরাতে পারবে। নিজেদের প্রয়োজনে কৃষ্ণবিবর ব্যবহার করতে পারবে। নিজেরাই সুপারনোভা বানাতে পারবে। অথবা সুপারনোভাকে বিলম্বিত করতে পারবে।

কারদাশেভ স্কেলে সবচেয়ে বেশি অগ্রসর সভ্যতা হলো টাইপ থ্রি সভ্যতা। তারা গ্যালাকটিক ক্ষমতার অধিকারী। এখানকার অধিবাসীরা ট্রান্সগ্যালাকটিক এবং ইন্টারগ্যালাকটিক ভ্রমণে সক্ষম হবে। তারা নিজেদের জন্য ছায়াপথের জ্বালানি নিয়েও কাজ করতে পারবে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যেকোনো প্রান্তেই তারা টিকে থাকতে পারবে।

টাইপ থ্রি সভ্যতার পরে কারদাশেভ আর কোনো সভ্যতার কথা চিন্তা করেননি। তবে কোনো কোনো বিজ্ঞানী কারদাশেভ-স্কেলকে টাইপ সেভেন পর্যন্ত বিস্তৃত করেছেন। যত ওপরের দিকে গেছে, সভ্যতাগুলোর প্রতিপত্তি ততই বেড়েছে।

৭৫ শতাংশ পর্যন্ত জ্বালানি ব্যবহার করেও মানব সম্প্রদায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। তবে আমরা যদি নিজেদের টাইপ ওয়ান সভ্যতায় রূপান্তর করতে পারি, সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি কিছুটা কমবে। তাই আমাদের বিলুপ্তির যে আশঙ্কা রয়েছে, তা প্রথমেই রোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতিও রয়েছে। আনুগ্রহ ভ্রমণে সক্ষম না হলেও আমরা মহাকাশে নভোযান পাঠিয়েছি। চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে কলোনি স্থাপনের চিন্তাভাবনা চলছে। তাই আগামী কয়েক দশকের মধ্যে মহাকাশে কোনো দুর্যোগ দেখা দিলে ব্রহ্মাণ্ডের মাঝে কিছু মানুষ টিকে থাকবে, সে আশা আমরা করতে পারি।

ভূমিকম্প প্রতিরোধ করতে না পারলেও এখন আগে থেকে আমরা একে শনাক্ত করতে পারি। সে অনুযায়ী মানুষকে সতর্ক করে দিতে পারি। পৃথিবীর আশপাশে যেসব গ্রহাণুর আনাগোনা আছে, সেগুলো আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি। সেগুলো যাতে পৃথিবীপৃষ্ঠে আঘাত না হানে কিংবা তাদের কীভাবে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, সে বিষয়েও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এসব অগ্রগতি আমাদের বলে দিচ্ছে, আমরা টাইপ ওয়ান সভ্যতার অভিমুখে ছুটছি। কিন্তু আমরা কি খুব দ্রুত সেখানে যেতে পারব? এর উত্তর আমাদের কারও কাছেই নেই। যদিও আমরা সবাই আশাবাদী। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সেখানে যেতে আমাদের আরও উদ্ভাবনী সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।