নবম গ্রহের খোঁজে

সৌরজগতে গ্রহ কয়টি? একটু পুরোনো বইগুলো খুঁজলে পাবেন নয়টি। বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, শনি, বৃহস্পতি, ইউরেনাস, নেপচুন আর প্লুটো। ২০০৬ সালে প্লুটোর গ্রহত্ব বাতিল করে বামন গ্রহের দলে ফেলা হয়। এরপর থেকে আবারও গ্রহের সংখ্যা আটটি। তবে আবারও চলছে নবম গ্রহের খোঁজ।

মহাকাশে নবম গ্রহের খোঁজের ইতিহাস বহু পুরোনো। ১৮ শতকে ধারণা করা হয়েছিল মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝে একটি গ্রহ আছে, যার নামকরণ করা হয় গ্রিক দেবতা ফেইথনের নামে। ১৮০১ সালে ওই অঞ্চলেই সেরেস নামে একটি বড় গ্রহাণু (সূর্যকে ঘিরে ঘোরা পাথুরে বস্তু) আবিষ্কৃত হলে সবাই ধারণা করে, এটাই ফেইথন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ওই অঞ্চলে আরও এমন বড় বস্তু আবিষ্কৃত হয়। প্লানেট ফাইভ নামে মাঝে মাঝে উল্লিখিত হওয়া ফেইথন গ্রহ তাই আর প্রমাণিত হয়নি।

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র ব্যবহার করে সব গ্রহের গতিপথ সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু সমস্যা বাধে বুধ গ্রহকে নিয়ে। এমনিতে সব গ্রহ ঘোরে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। উপবৃত্তাকার মানে কিছুটা চ্যাপ্টা বৃত্ত। তাই সূর্য থেকে কোনো গ্রহের দূরত্ব সব সময় একই থাকে না। কমে-বাড়ে। যে বিন্দুতে গ্রহ সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে তাকে বলে অনুসূর বিন্দু । নিউটনের সূত্রানুযায়ী এই অনুসূর বিন্দু সব সময় একই হওয়ার কথা। বুধের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই বিন্দু ধীরে ধীরে সরে যায়। এটি ব্যাখ্যা করতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি গণিতবিদ লা ভেরিয়ার প্রস্তাব করেন, সূর্য আর বুধ গ্রহের মাঝে আরেকটি ছোট গ্রহ ঘুরছে, যা বুধের গতিপথকে এমন অদ্ভুত বানিয়ে দিচ্ছে। এই গ্রহের নাম দেওয়া হয় ভলকান। এরপর অনেকেই বিভিন্ন সময় দাবি করতে থাকেন, তাঁরা এই গ্রহটি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু এমন কোনো গ্রহের অস্তিত্ব পরে পাওয়া যায়নি। বুধের অনুসূরের সমস্যার সমাধান হয় আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের মাধ্যমে। যদিও এরপরও বহু বছর অনেকে ভাবতে থাকেন, ভলকান নামে একটি গ্রহ আছে।

১৮৪৬ সালে নেপচুন আবিষ্কারের পর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, এর থেকেও দূরে নিশ্চয় কোনো গ্রহ আছে। তাত্ত্বিকভাবে প্রাপ্ত ইউরেনাস ও নেপচুনের কক্ষপথের সঙ্গে বাস্তবে কিছু অমিল পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পারসিভাল লওয়েল প্রস্তাব করেন, প্লানেট এক্স নামে একটি গ্রহ আছে নেপচুনের বাইরে। এবার তল্লাশি শুরু হয় প্লানেট এক্সের।

এদিকে ১৯৩০ সালে ক্লাইড টম্বাউ প্লুটো আবিষ্কার করেন। তখন অনেকেই ধরে নেন প্লুটোই প্লানেট এক্স। ১৯১৫ সালের আগে লওয়েল হিসাব করেছিলেন, প্লানেট এক্সের ভর হবে পৃথিবীর সাত গুণ। ১৯৩১ সালে হিসাব করা হয়, প্লুটোর ভর প্রায় পৃথিবীর সমান। তাতে প্লটোই প্লানেট এক্স, এই ধারণায় কিছুটা ভাটা পড়ে। এরপর যত দিন গেছে, প্লুটোর ভরের ব্যাপারে আরও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, আসলে প্লুটোর ভর আরও অনেক কম। ২০০৬ সালে হিসাব করে দেখা যায়, প্লুটোর ভর পৃথিবীর ভরের ৪৫৯ ভাগের মাত্র ১ ভাগ। অর্থাৎ প্লুটো যে প্লানেট এক্স নয়, সেটি নিশ্চিত হওয়া গেল।

প্লুটোর ভর ধারণার চেয়ে অনেক কম। তাই অন্য কোথাও প্লানেট এক্সের খোঁজ চলতে থাকে। প্লানেট এক্স কেমন হবে এ বিষয়ে নানা তত্ত্ব হাজির করেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু ১৯৮৯ সালে ‘ভয়েজার ২’ নেপচুনের পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় নেপচুন সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করে। সেই তথ্য থেকে দেখা যায়, নেপচুনের আগের যে ভর ধারণা করা হয়েছিল, তার চেয়ে প্রায় ০.৫% কম ভর আছে। অর্থাৎ প্রায় মঙ্গল গ্রহের সমান কম ভর। নতুন হিসাব করে পাওয়া ইউরেনাসের কক্ষপথে আর ঝামেলা থাকে না। এভাবেই শেষ হয় প্লানেট এক্স।

কিন্তু প্লানেট এক্স না থাকলেও নবম গ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানীদের খোঁজাখুঁজি কিন্তু শেষ হয়নি। ২০১৪ সালে পৃথিবী সূর্যের দূরত্বের কমপক্ষে ৮০ গুণ দূরে একটি গ্রহাণু আবিষ্কৃত হয়। আবারও নতুন করে আলোচনায় আসে নবম গ্রহ। ২০১৬ সালের শুরুতে ক্যালটেকের বিজ্ঞানী কন্সটান্টিন ব্যাতিজিন ও মাইকেল ব্রাউন এ বিষয়ে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেন। তাঁরা জানান, নেপচুন থেকে বহু দূরে নবম গ্রহ থাকলে তা কীভাবে ইউরেনাস নেপচুনের মতো দূরবর্তী গ্রহগুলোর কক্ষপথ ব্যাখ্যায় সাহায্য করবে। এমনকি তাঁরা গ্রহটির সম্ভাব্য ভর, কক্ষপথ ও সূর্য থেকে দূরত্বও হিসাব করেন। তাঁদের হিসাবে, এটির ভর হবে পৃথিবীর দশ গুণ। ব্যাসার্ধ হবে দুই থেকে চার গুণ। আর সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগবে পৃথিবীর হিসাবে প্রায় ১০ থেকে ২০ হাজার বছর।

এদিকে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী রেণু মালহোত্রা সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী চারটি এস্টেরয়েডের গতিপথ পরীক্ষা করে দেখেছেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করেন, এগুলোর গতিপথ চমত্কারভাবে পরস্পরের সঙ্গে শৃঙ্খলিত। এর একটাই অর্থ হতে পারে, এগুলোর ওপর ভারী কোনো বস্তুর প্রভাব রয়েছে। তাঁদের করা হিসাবও মিলে যায় ব্যাতিজিন আর ব্রাউনের করা হিসাবের সঙ্গে।

প্রায় দেড় শ বছর ধরে সূর্যের একটি ধাঁধা অমীমাংসিত। সূর্য ঘোরার সময় প্রায় ৬ ডিগ্রি কাত হয়ে ঘোরে। অর্থাৎ পৃথিবীসহ অন্য সব গ্রহ যে তলে ঘোরে, তার সঙ্গে ৬ ডিগ্রি কাত। এমন বিশাল ভারী একটা বস্তুর জন্য এটি অনেক বেশি। এখন পর্যন্ত এর সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্রাউনের আগের গবেষণার পথ ধরে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন ক্যালটেকের পিএইচডি গবেষক এলিজাবেথ বেইলি। তিনি দেখিয়েছেন, নবম গ্রহই এর জন্য দায়ী। পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ যে তলে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, নবম গ্রহ অন্তত ৩০ ডিগ্রি কাত হওয়া একটি তলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এটির অনেক বেশি ভর ও কাত হওয়া তলের কক্ষপথের প্রভাবে সূর্যের ঘূর্ণন অক্ষ ৬ ডিগ্রি কাত হয়ে আছে।

পরপর এসব আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের নবম গ্রহ খুঁজে পেতে আশাবাদী করে তুলছে। কিন্তু কে খুঁজবে এই গ্রহ? আগের গ্রহগুলোর অনেকগুলো শখের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু নবম গ্রহ শখের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দিয়ে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এত দূরে সূর্যের আলো পৌঁছায় খুবই সামান্য। সেই আলোয় নবম গ্রহ যে আলোকিত না-ও হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এ জন্য প্রয়োজন অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ। ফোর্বস-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে ধারণা করা হয়েছে, নাসা নবম গ্রহ খোঁজার জন্য হাবল টেলিস্কোপ বরাদ্দ দেবে না। তবে জাপানের ন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরিতে অনেক বিজ্ঞানী নবম গ্রহ নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁদের মধ্য থেকেই কোনো এক বিজ্ঞানী হয়তো নবম গ্রহ খুঁজে পেয়ে হইচই ফেলে দেবেন। তাতে হয়তো শেষ হবে দুই শতাব্দীর অনুসন্ধান কাজ। মীমাংসা হতে পারে সৌরজগতের রহস্যও। নাকি শুরু হবে দশম গ্রহের খোঁজ।

লেখক: অলিম্পিয়াড বিষয়ক উপদেষ্টা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়

সূত্র: পাথওয়েজ অব অ্যাস্ট্রোনমি/ স্টিফেন ই স্নেইডার ও থমাস টি আর্নি এবং ফিলিপস এটলাস অব দ্য ইউনিভার্স, উইকিপিডিয়া ও সায়েন্টিফিক আমেরিকান