চোখের সামনে মহাজাগতিক রহস্য

১৩০০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বে নাকি কোনো নক্ষত্র ছিল না! তার মানে কোনো গ্রহও ছিল না। তখন মহাকাশজুড়ে ছিল বড় বড় আকৃতির ঘন পদার্থের অদৃশ্য বস্তু। আর ছিল হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম গ্যাসের রাজত্ব। তারপর? ঘন বস্তুর অভিকর্ষে গ্যাস সঞ্চিত হয়ে জন্ম হলো নক্ষত্রের। তবে এসব নক্ষত্র খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। আকারেও ছিল বিশাল। গ্যাসের পর্যায়ক্রমিক আবহের কারণে এগুলো উত্তপ্ত হতো। তারপর সব সঞ্চিত জ্বালানি ফুরিয়ে আশপাশে গ্যাস ছড়িয়ে খুব দ্রুত বিস্ফোরিত হতো। এভাবেই পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যেত নক্ষত্রগুলো। বিজ্ঞানীরা এদের নাম দিলেন ‘সুপারনোভা’! সুপারনোভার বিস্ফোরণে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম গ্যাস ছাড়াও কার্বন, অক্সিজেন ইত্যাদি আরও বহু গ্যাস ছড়িয়ে পড়ত। এগুলো আবার একত্র হয়ে নক্ষত্রের জন্ম দিত। এটা একটা চক্রের মতো। নক্ষত্র তৈরি হয়, আবার বিস্ফোরিত হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে দেয় নতুন আরও গ্রহ-নক্ষত্র তৈরি হওয়ার উপাদান। এই মহাকাশে প্রতিনিয়ত এভাবে কত যে নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে, তা একবার ভাবুন তো!

এসব মহাজাগতিক রহস্য চোখের সামনে যেন স্পষ্ট ঘটতে দেখা যায় প্ল্যানেটারিয়ামে বা নভোথিয়েটারে।

রাতের আকাশ আর সুবিশাল মহাবিশ্বের ঘটনাগুলো ছোট পরিসরে দেখাতে ও জানাতে যে থিয়েটার তৈরি করা হয়, তা-ই প্ল্যানেটারিয়াম। বাংলাদেশে ২০০৪ সাল থেকে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে দেশের একমাত্র প্ল্যানেটারিয়াম, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার। এখানকার সুবিশাল অর্ধগোলকের সিলিংয়ে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি পর্দাটা যেন একটা মহাকাশ। সেখানে এক এক করে ঘটে চলে মহাজাগতিক সব ঘটনা। স্থপতি আলী ইমামের নকশায় করা নভোথিয়েটারে সেই আয়োজন দেখে বিজ্ঞানপিপাসু দর্শকেরা আনন্দ পান।

প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কয়েক বছর বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারে দুটি প্লানেট শো চলত। সেগুলো চলত অ্যানালগ কৌশলে। ২০১৪ সাল থেকে সবকিছু ডিজিটালাইজড করা হয়। এখন দিনের বিভিন্ন সময়ে প্লানেট শো চলে মোট ছয়টি। রয়েছে ‘মিশন টু ব্ল্যাকহোল’, ‘জার্নি টু দ্য স্টারস’, ‘গুডনাইট গোল্ডিলক্স’-এর মতো কিছু বিশেষ শো। সবটা দেখার পর বিশাল অন্ধকার অর্ধগোলক কক্ষ থেকে বের হলে সময় যেন কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। ইচ্ছে করে ছুটে বের হয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকাই। চিরচেনা সাদামাটা আকাশটাকে তখন একটু যেন অচেনাই লাগে!

নভোথিয়েটারের দোতলায় ফাইভ-ডি মুভি থিয়েটারের সামনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফরিদ আহমেদ কিছুটা অলস সময় কাটাচ্ছিলেন বলে মনে হলো। জানা গেল, নতুন সংযোজিত মুভি থিয়েটারটিতে দর্শক উপস্থিতি নাকি তেমন না। ফাইভ-ডি মুভিতে চলমান ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কম্পন অনুভব করা যায়। সেই সঙ্গে ওই পরিস্থিতির পারিপার্শ্বিক বিষয়, যেমন ধোঁয়ার উপস্থিতি কিংবা জলকণা গায়ে পড়ার অনুভূতিও ছুঁয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের এই ফাইভ-ডি মুভি থিয়েটারে মোশন চেয়ারে বসে বাস@বিক দৃশ্যে পৌঁছে যাওয়ার মতো এমন শিহরণ কেন দর্শক টানতে পারছে না, ভেবে খটকা লাগল। উত্তরটা পাওয়া গেল মহাপরিচালকের কথায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্¿ণালয়ের যুগ্ম সচিব ও নভোথিয়েটারের মহাপরিচালক আবুল বাশার মো. জহরুল ইসলাম বলেন, ‘মুভি থিয়েটারের পর্দা একটু ঘোলা হয়ে গেছে। আগের মতো সেই শিহরিত অনুভূতি কিছুটা কম পাওয়া যাচ্ছে।’ তিনি অবশ্য খুব দ্রুত তা সারানোর আশ্বাস দিলেন।

 ‘ডিজিটাল ও সায়েন্টিফিক এক্সিবিটস গ্যালারি’তে মজার সব প্রদর্শনী চোখে পড়ল। মনে মনে ভাবলাম, শিশু-কিশোরদের জন্য চমত্কার বিজ্ঞান-আগ্রহী আয়োজন সাজিয়ে দিয়েছেন কোরীয়রা। আর্থকোয়াক সিস্টেম, হেলিকপ্টার হোভারিং, ম্যাজিক ভিশন, এলিয়েন সিস্টেম, ইমোশনাল স্পিচ আরও অনেক বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের সমাধান মিলিয়ে মোট ৩০টি প্রদর্শনী আছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সৌরজগতে বিভিন্ন গ্রহে আপনার ওজন কত হবে, তা পরিমাপের একটি যন্¿ও সেখানে আছে। তবে এখানেও বেশ কটি প্রদর্শনী অকেজো পড়ে থাকতে দেখা গেল। সহকারী কিউরেটর মো. শহিদুল ইসলাম আশ্বস@ করলেন, ‘দু-এক দিনের মধ্যেই দরপত্রের কাজ শেষ হবে। তারপরই প্রয়োজনীয় কাজ শেষে সেগুলো পুনরায় চালু হবে।’

ভারত থেকে আনা রাইড সিম্যুলেটরটিতে ৩০ ডিগ্রি কোণে এবং আনুভূমিক ও উলম্ব তলে রোলার কোস্টার ভ্রমণটিও ভীষণ চমকপ্রদ।

প্লানেট শো শুরুর আগ পর্যন্ত টিকিট ছাড়াই সূর্য, চাঁদ, পৃথিবীর মডেল, মহাকাশবিষয়ক তথ্যচিত্র, সৌরজগতের মডেল দেখে সময় কাটানোর ব্যবস্থা আছে। হঠাৎ চোখে পড়ল, বামন গ্রহ খেতাবপ্রাপ্ত প্লুটো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটারে এখনো গ্রহ হয়েই টিকে আছে।

মূল চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান জাপানি কোম্পানি ‘গোটো ইন করপোরেশন জাপান সবকিছুর দেখভাল করে। বছরে মাত্র দুবারই এ কোম্পানি থেকে লোক বাংলাদেশে আসেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতে এগুলো মেরামতের উপায় নেই।

 ছবি: আশরাফুল আলম

লেখক: শিক্ষার্থী, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়