অ্যান্টিবায়োটিকে সাবধান!

রাহেলা তাঁর জীবনে প্রথমবার মা হতে চলেছেন। গ্রাম থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তা-ও তাঁরা এক দিন আগে চলে এসেছেন হাসপাতালে। কোনো জটিলতা ছাড়াই প্রথম সন্তানকে পৃথিবীতে স্বাগত জানাতে চান তাঁরা। দীর্ঘ আট ঘণ্টা প্রসবযন্ত্রণার পর ছেলেসন্তান ভূমিষ্ঠ হলো। কিন্তু জন্মের পরপরই শিশুটির ভয়ানক শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। এই শীত মৌসুমে এটি খুবই স্বাভাবিক। পরীক্ষা করে জরুরি ভিত্তিতে বাচ্চাকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করলেন চিকিত্সক। এক দিন পরে বাচ্চার অবস্থার আরও অবনতি হলো। শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের নিচের অংশ নিচের দিকে দেবে যাচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক কালচার সেনসিটিভিটি টেস্ট করে দেখা গেল, Amoxicillin, Cotrimoxazole, Nalidixic Acid, Gentamicin, Ceftazidime, Amikacin, Ciprofloxacine, Ceftriaxone, Cefotaxime, Cefuroxime, Aztreonam এবং Netilmicin গ্রুপের প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে তার শরীরে আক্রমণকারী জীবাণুটি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। অর্থাত্ কোনো অ্যান্টিবায়োটিক শিশুটির জন্য এখন কার্যকর নয়, একমাত্র Meropenem বাকি আছে। চিকিত্সক হতবাক। এই বাচ্চার যদি এখনই এ অবস্থা হয়, তাকে এবারের মতো সুস্থ করে তোলা যাবে হয়তো কিন্তু তাকে দীর্ঘ জীবনের বাকি দিনগুলোতে নিশ্চয়তা দেওয়ার মতো কিছুই রইল না। কিন্তু কী এই অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স?

এককথায় জীবাণুগুলোর অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে যাওয়াকেই বলে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স। বিবর্তনের নিয়মেই একটি প্রজাতি ক্রমাগত একই ধরনের বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে বহুদিন আসতে থাকলে সেই প্রজাতির মধ্যে জিনগত পরিবর্তন আসে। সেই জিন প্রজাতির বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন সাধারণত ঘটে ধীরে ধীরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তারই ধারাবাহিকতায় হঠাত্ করেই এমন একটি পরিবর্তন আসে, যখন প্রজাতির কিছু সদস্য তৈরি হবে, যার ওপর সেই অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না। সে হয়ে যাবে সেই অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্ট বা রোধক। এদের নাম দেওয়া হয়েছে সুপারবাগ। সুপারবাগ কতটা ভয়ংকর, সেটা বুঝতে হলে একটু ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।

প্লেগ, কলেরা, যক্ষ্মায় একসময় লাখ লাখ লোক মারা যেত। ব্যাকটেরিয়াজনিত এসব রোগের সে যুগে কোনো ওষুধ ছিল না। এ অবস্থার পরিবর্তন আসে আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর। মাত্র এক শতাব্দী আগের কথা। পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করলেন। তারই ফসল আজকের চিকিত্সাবিজ্ঞানের জয়যাত্রা।

যক্ষ্মা, কলেরাকে এখন কেউ পাত্তাই দেয় না। সবাই জানে এসব রোগের চিকিত্সা আছে। অনেকের আবার ডাক্তারের পরামর্শও নেওয়ার দরকার পড়ে না। জ্বর হলেই একটা অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন সুস্থ। তার পরও খারাপ লাগলে হয়তো আর দু-এক ডোজ। এরপর শরীর একটু ভালো হয়ে গেলেই আর ওষুধ খান না তাঁরা। সাময়িক সুস্থ হয়ে খুশিমনে জীবনের গতিতে চলতে থাকেন। কিন্তু তাঁদের কারণে এমন সমস্যার সৃষ্টি হয়, মাশুল গুনতে হয় প্রত্যেক মানুষকে। এমনকি যাঁরা অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেননি, তাঁরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

অ্যান্টিবায়োটিকের পুরো কোর্স শেষ না করলে দেহের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় না। দেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তখন দেহের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। মানুষটি আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ হলেও তাঁর ভেতরে যে অল্প কিছু জীবাণু রয়ে গেছে, সেগুলো শিখে যায় কী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক তাঁর ক্ষতি করতে পারে। তারপর কয়েক প্রজন্মে তাঁর জেনেটিক পরিবর্তন ঘটে এবং সেই সব অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে টিকে থাকা শেখে। এরা বংশপরম্পরায় এই বৈশিষ্ট্য রেখে যায়। এগুলোই সেই সুপারবাগ। পরবর্তীকালে একই অ্যান্টিবায়োটিক আর সেই সুপারবাগের ওপর কাজ করে না। আবার এই সুপারবাগ বায়ু, পানি, মাটি ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে অন্য কারও দেহে প্রবেশ করে। এতে দেখা যায়, নতুন পোষকের শরীরেও সেই অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করে না। তখন আরও শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। ভয়ংকর একটি ব্যাপার।

কিন্তু এর চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক ইচ্ছা করলেই আবিষ্কার করা যায় না। ধীরে ধীরে অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার কমে আসতে আসতে এখন এক আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ধারণা করা হচ্ছে, শিগগিরই এসব সুপারবাগের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো আমাদের আর কোনো ওষুধ থাকবে না।

এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক আমরা হরহামেশা ব্যবহার করছি। যেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর বিরুদ্ধে প্রায় সব ব্যাকটেরিয়া সম্পূর্ণ রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিগগিরই এমন এক অবস্থায় আমরা উপনীত হব, যখন আর অ্যান্টিবায়োটিক কাজই করবে না। আবার আমরা সেই পুরোনো যুগে ফিরে যাব, যখন কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম মানুষ মারা যেত।

এবার ফিরে আসি সেই শিশুটির কথায়। এই শিশুটিকে তার শরীরে কাজ করবে এমন একমাত্র অ্যান্টিবায়োটিক Meropenem দিয়ে ভালো করে তোলা হলো সেবারকার মতো। কিন্তু সে কি জীবনে আর কখনো সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে অসুস্থ হবে না? তখন কী অ্যান্টিবায়োটিক দেবেন?

এ জন্য দরকার সচেতনতা। ভুলেও চিকিত্সকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করবেন না। অবশ্যই একবার শুরু করলে এর ফুল কোর্স সম্পন্ন করবেন। উন্নত দেশে এখন রেজিস্টার্ড চিকিত্সকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রিই আইনত দণ্ডনীয়। সচেতনতা না বাড়ালে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের মানুষই হবেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

লেখক: শিক্ষার্থী, জালালাবাদ মেডিকেল কলেজ, সিলেট।