হিংস্রতার উত্স সন্ধানে

টেলিভিশনের পর্দায় এই দৃশ্যটা মাঝেমধ্যেই ভেসে উঠতে দেখি: সড়কি, বল্লম ও টেঁটা (মাছ ধরার কাজে ব্যবহূত একধরনের অস্ত্র) হাতে একদল লোক ছুটছে একই রকম অস্ত্রে সজ্জিত আরেক দল লোকের দিকে। দুই দল লোকেরই লুঙ্গি কাছামারা।

কখনো কখনো দেখি, একটা ফাঁকা মাঠের দুই প্রান্তে জড়ো হয়েছে দুদল লোক। পরস্পরের দিকে তারা ইটপাটকেল ও সড়কি ছুড়ে মারছে। যে কেউ এটাকে উত্সব-দৃশ্য ভেবে ভুল করতে পারেন। নরসিংদী আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চরাঞ্চলে এই দৃশ্য বেশি দেখা যায়। সেখানে পাশাপাশি অবস্থিত দুটি গ্রামের মধ্যে এ রকম মরণপণ যুদ্ধ মাঝেমধ্যেই বাধে। কোনো একটা সুনির্দিষ্ট ঘটনা থেকে হয়তো লেগেছে মারামারি। তারপর সেটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। একটি গ্রাম দাঁড়িয়ে গেছে আরেকটি গ্রামের বিরুদ্ধে।

আমি যে অঞ্চলের কথা বলছি, সেখানে এ রকম লড়াই চলতে থাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। একসময় যুযুধান পক্ষগুলো ভুলেই যায়, এই সংঘাত আদিতে কী কারণে লেগেছিল, কিসের জন্য এই শত্রুতা। কিংবা কারণটা তখন গৌণ হয়ে যায়। মিটমাটের ঊর্ধ্বে চলে যায় সবকিছু। এক গ্রামের লোক অন্য গ্রামের লোক পেলেই পিটিয়ে মেরে ফেলে। শুনেছি, কিছু কিছু গ্রামে এ লড়াই চলছে কয়েক প্রজন্ম ধরে। ফলে টিভির পর্দায় যে লড়াইয়ের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, সেটা হয়তো এ রকম দীর্ঘ লড়াই পর্বের কোনো মধ্যবর্তী এপিসোড।

মানুষে মানুষে নানা কারণেই কাজিয়া বেধে যায়। কিন্তু এখানে যে বিশেষ লড়াইয়ের কথা বলছি, সেগুলোর মাথামুণ্ডু পাই না। কেন লোকে খামাখা নিজের জীবন বিপন্ন করে এমন এক লড়াইয়ে শামিল হয়, যার সঙ্গে তার নিজের স্বার্থের কোনো যোগ নেই? আমি ‘ক’ গ্রামের বাসিন্দা, শুধু এ কারণেই আমার জীবনের লক্ষ্য হলো ‘খ’ গ্রামের বাসিন্দাকে খতম করা, অথবা ‘খ’ গ্রামের বাসিন্দার হাতে খতম হয়ে যাওয়া—এর অর্থ কী? কী কারণে হত্যার স্পৃহা আর ঘৃণা ছাপিয়ে যায় যুক্তি আর প্রেমের আবেগকে? এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে, এটা স্রেফ পাগলামি। হ্যাঁ, বটেই তো। ভূতগ্রস্তের মতোই আচরণ। কিন্তু কী সেই রোগ, জবাব পাওয়া মুশকিল।

সাইকো-অ্যানালিস্টরা এত দিন এটার একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ডেথ-ড্রাইভ ধারণা দিয়ে। ব্যক্তিমানুষের মধ্যে প্রাণের স্ফুরণের বিপরীত একটি প্রবণতা সমান শক্তি নিয়ে কাজ করে। ফ্রয়েড সেটার নাম দিয়েছেন ডেথ-ড্রাইভ। তবে এটা ফ্রয়েডের একটা অনুমান। সাইকো-অ্যানালিস্টরা যেকোনো মানসিক প্রবণতা বা এষণার বাইনারি অপজিশন কল্পনা করেন। এটা সে রকমই এক তাত্ত্বিক ধারণা। ফ্রয়েড নিজে এটা খুব যে জোরালোভাবে বিশ্বাস করতেন, এমন নয়। তা ছাড়া ব্যক্তির ডেথ-ড্রাইভ কী করে সামষ্টিক আচরণের কাঠামোয় রূপান্তরিত হয়, সেটারও ব্যাখ্যা নেই মনোবিশ্লেষণে।

মানুষের এই অর্থহীন, খামাখা সংঘাতপ্রবণতার সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা হাজির করতে পেরেছেন কনরাড লরেনত্স নামের এক অস্ট্রিয়ান জীববিজ্ঞানী। তিনি বলেছেন, এটা খামাখা নয়। সংঘাতের একটা গভীর বিবর্তনবাদী উপযোগিতা আছে।

কনরাড লরেনত্স এই ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছেন পানির তলায়, মাছের রাজ্যে। ফ্লোরিডা উপকূলে প্রবাল প্রাচীরঘেরা সাগরের তলে কতগুলো বিশেষ ধরনের মাছের আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করছিলেন লরেনত্স। তাঁর লক্ষ্য ছিল, প্রবাল প্রাচীরঘেঁষা অঞ্চলে বিশেষ কিছু মাছের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত হিংস্রতার কারণ খুঁজে বের করা। মাছের এই হিংস্রতার সঙ্গে তাদের আঁশের কটকটে উজ্জ্বল ডোরাকাটা রঙের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সেটাও অনুসন্ধান করছিলেন তিনি। আর পানির তলায় সাঁতার কাটতে কাটতে তিনি লক্ষ করেন, শুধু মাছ নয়, পুরো প্রাণিজগতেই হিংস্র আচরণের এক অভিন্ন প্যাটার্ন আছে।

ষাটের দশকে লরেনত্স একটা বই লেখেন জার্মান ভাষায়। ইংরেজি ভাষায় অনুবাদে যেটার নাম দাঁড়ায় অন অ্যাগ্রেশন। সহজ বাংলা করলে দাঁড়াবে আগ্রাসন বিষয়ে।

ওই বইতে লরেনত্স সবার আগে যে কাজটা করেছেন, তা হলো হিংস্র আচরণ আর আগ্রাসী আচরণের মধ্যে একটা ভেদরেখা টেনে দিয়েছেন। তিনি বলছেন, টিকে থাকার লড়াইয়ে একটি প্রজাতির একটি প্রাণী যখন অপর প্রজাতির কোনো প্রাণীকে আক্রমণ করে, সেটাকে আমরা হিংস্রতা বলতে পারি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই হিংস্রতা ঘটে খাদ্য-খাদক বা শিকার-শিকারি সম্পর্কে যুক্ত প্রাণীদের মধ্যে। কিন্তু একটি প্রজাতির প্রাণীরা যখন প্রবল জিঘাংসায় নিজ প্রজাতির অপর সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেটা একেবারেই ভিন্ন জিনিস। লরেনত্স সেটার নাম দিয়েছেন আগ্রাসন বা আগ্রাসী হিংস্রতা। সমাজবদ্ধ অথবা নিঃসঙ্গ উভয় ধরনের প্রাণীদের মধ্যেই এ ধরনের স্বজাতিঘাতী আগ্রাসী হিংস্রতা প্রকটভাবে দেখা যায়। সেটা দেখা যায় মাছের মধ্যে, পিঁপড়ার মধ্যে, বাদামি ইঁদুরের মধ্যে, বালিহাঁসের ঝাঁকে, উইপোকার রাজ্যে এবং এমনকি শান্তির প্রতীক পায়রাও এই প্রবণতার বাইরে নয়।

অন অ্যাগ্রেশন বইতে লরেনত্স বিভিন্ন ধরনের প্রাণীদের মধ্যে আগ্রাসী হিংস্রতার ভূরি ভূরি উদাহরণ টেনেছেন। এসব আচরণের মধ্যে তুলনা টেনেছেন। এদের ক্যাটেগরি করার চেষ্টা করছেন। তবে এত কিছু করার মূল উদ্দেশ্য, মানুষের আচরণের ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা, মানুষের আগ্রাসী, ভ্রাতৃঘাতী জিঘাংসার রহস্য উন্মোচন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, কনরাড লরেনত্স যখন ডুবুরির পোশাক পরে ফ্লোরিডা উপকূলের শান্ত সুনীল জলরাশির নিচে প্রবাল প্রাচীরের ধার ঘেঁষে সাঁতরে বেড়াচ্ছেন আর মাছের আচরণ বোঝার চেষ্টা করছেন, তার বছর দশেক আগে মানুষ দু-দুটো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ওই এক বিশাল ধাক্কায় দুনিয়াজুড়ে সবাই জেনে গেছে, ভ্রাতৃঘাতী জিঘাংসার বশে মানুষ এখন পুরো প্রজাতিকে এক লহমায় ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। ফলে প্রজাতির ভবিষ্যত্ নিয়ে একটা শঙ্কা দুনিয়াজুড়ে দানা বাঁধছে। মানুষ বোঝার চেষ্টা করছে তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ধ্বংসাত্মক প্রবণতাগুলোর উত্স।

মানুষের আচরণের ব্যাখ্যা মানুষের বাইরে প্রাণিজগতের অন্য প্রজাতিগুলোর আচরণের মধ্যে খুঁজতে যাওয়া—এ এক নতুন বিদ্যা। লরেনত্স তখনো জানতেন না, তিনি আসলে একটা রহস্য সমাধানে গোয়েন্দার ভূমিকাই শুধু পালন করছেন না, তিনি আসলে ভবিষ্যতে একই রকম গোয়েন্দাগিরির একটা ধারা বা বিদ্যার জন্ম দিচ্ছেন। সেই বিদ্যার নাম ইথোলজি, পরবর্তীকালে আরও বেশ কয়েকজন জীববিজ্ঞানী এই পথে হেঁটে একটা স্থায়ী রাস্তা তৈরি করে ফেলবেন।

কনরাড বলেছেন, সংঘাতের এ প্রবণতার ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে টেরিটরি বা নিজের বিচরণ অঞ্চল রক্ষার  তাগিদের মধ্যে। কিন্তু টেরিটরি কেন এভাবে রক্ষা করতে হবে? ভাগাভাগি করে নিতে সমস্যা কোথায়? ভাগাভাগিতে সমস্যা আছে। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে খাদ্য একই প্রজাতির অনেক সদস্য ভোগ করতে থাকলে পুষ্টিতে টান পড়ে। ভাগাভাগিতে প্রজাতির সদস্যরা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। টিকে থাকার সংগ্রামে তাদের শক্তি কমে যায়।

আগ্রাসী হিংস্রতা আসলে একটি ভাষামাত্র। একটি সংকেত, এটা প্রজাতির জনসংখ্যা বা উপনিবেশকে ভৌগোলিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি অন্তর্গত তাগিদ। নিজ প্রজাতির অপর সদস্যদের প্রতি এই ঘৃণা প্রজাতির অপর সদস্যদের দলত্যাগে বাধ্য করে। প্রজাতির সদস্যরা ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। নতুন নতুন উপনিবেশ গড়ে ওঠে।

লরেনত্স দেখিয়েছেন, বাদামি ইঁদুরের মধ্যে দলবদ্ধ হয়ে বসবাসের প্রবণতা আছে ঠিক মানুষের মতো। একটি দলের সদস্যদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ভীষণ দৃঢ়। একের জন্য অপরজন জীবন বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু ইঁদুরের একটি দল প্রবলভাবে ঘৃণা করে একই প্রজাতির অপর দলকে। প্রতিটি দলের সদস্যরা তাদের নিজ দলের সদস্যদের চেনে নির্দিষ্ট একটি গন্ধের মাধ্যমে। অপর দলের ইঁদুরের গায়ের গন্ধ তাদের কাছে অসহ্য মনে হয়। অর্থাত্, গন্ধ এখানে পতাকার মতো কাজ করে। বাদামি ইঁদুরের দুটি দল পরস্পর কাছাকাছি হলেই একে অপরের অপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কচুকাটা করে একে অপরকে। এ কারণে বাদামি ইঁদুরের দুটি দল পরস্পরের নৈকট্য যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে। আর এতে দেখা যায়, এই ইঁদুরগুলো একটি ভূখণ্ডে সমভাবে বিস্তৃত। হিংসা এখানে জনসংখ্যার বণ্টন নিয়ন্ত্রণের একটি হাতিয়ার।

লরেনেসর এই বই ষাটের দশকে প্রবল আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। অনেকে এর সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে রাজি হননি। অনেকের আপত্তি ছিল কনরাড তাঁর আগ্রাসী প্রবণতাকে ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছেন বলে। কনরাড তাঁর বইয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে, নীতি-নৈতিকতার বেড়াজাল তুলে আগ্রাসনের প্রবণতাকে শাসন করার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু এটা পুরোপুরি চাপা দেওয়া যায় না। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো মানুষের ভেতরে এটা পুঞ্জীভূত হতে থাকে। যেকোনো ছুতোয় সেটা ভয়াবহ আকারে উদিগরণ ঘটায়। ঠিক ফ্রয়েডের অবচেতন প্রবণতাগুলোর অবদমনের মতোই।

লেখক: সাংবাদিক