আমেরিকার সংক্রামক রোগগুলো কোথায়?

৩ আগস্ট, ১৪৯২ সাল। তিনটি জাহাজ নিয়ে এশিয়ার পথে যাত্রা শুরু করলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস। দুই মাস পরে ১২ অক্টোবরে জাহাজ তিনটি দেখা পেল জমির। কিন্তু এ-তো এশিয়া নয়, মানুষের অজানা সম্পূর্ণ নতুন এক মহাদেশ। নতুন ধরনের গাছ পালা, পশুপাখি, মানুষ। পরে আরেকজন নাবিক আমেরিগো ভেসপুচির নামে মহাদেশের নামকরণ হয় আমেরিকা।

পনেরো শতকের শেষ থেকে ভিক্টোরিয়ান যুগ পর্যন্ত, চারশ বছরে আমেরিকা মহাদেশের আদি অধিবাসীদের সংখ্যা দশ ভাগের এক ভাগে নেমে আসে। কারণ? ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে যুদ্ধ, গণহত্যা অনেক আদিবাসীদের মৃত্যর কারণ ছিল। সুগঠিত নগর, গ্রাম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ইউরোপিয়ান যোদ্ধাদের হাতে। কিন্তু বন্দুক আর তলোয়ার নয়, আরো ভয়ঙ্কর অস্ত্র নিয়ে এসেছিল ইউরোপীয়রা- গুটি বসন্ত, টাইফাস, যক্ষা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, প্লেগ, কলেরা, মাম্পস, মিজলস এবং আরও অসংখ্য রোগ। এই সংক্রামক রোগগুলোর বিরুদ্ধে কোন ইমিউনিটিই ছিল না আমেরিকা মহাদেশের মানুষের- তাই কোটি কোটি মানুষ মারা পড়ে মহামারিতে।

ইউরোপীয় বনাম আদিবাসী যুদ্ধের ফল নির্ধারণ হয় এই জীবাণু অস্ত্রে, ঢাল-তলোয়ারের যুদ্ধ হবার আগেই। কিন্তু ইউরোপীয়ানদের আনা রোগে আমেরিকানরা আক্রান্ত হলে, আমেরিকানদের রোগে ইউরোপিয়ানরা আক্রান্ত হলো না কেন? 

প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে সংক্রামক রোগ কী? প্রথমত, সংক্রামক রোগ মানুষ থেকে মানুষে দ্রুত ছড়ায় - হাঁচি, কাশি, স্পর্শ, মলমূত্রের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, এসব রোগে মানুষ হয় মারা যায় অথবা সেই রোগের বিরুদ্ধে স্থায়ী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থা যদি যুদ্ধে জিততে পারে, তবে আজীবনের জন্য এই রোগের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অস্ত্র মজুদ রাখে। এজন্য পরে কখনও এই জীবাণুর আক্রমণ হলে সফলতার সঙ্গে ঠেকিয়ে দেয় সেটা। যেমন কারও একবার জলবসন্ত হলে কখনো আর হয় না। এই প্রতিরোধক্ষমতার মানুষটির শরীরে রোগ বাসা বেধে থাকতে পারে, তিনি ছড়াতে পারেন রোগ, কিন্তু এই রোগে আর কাবু হবেন না।

তো কেন ইউরোপিয়ানরা আক্রান্ত হলো না, এর সহজ উত্তর হলো আমেরিকা মহাদেশে সংক্রামক রোগ ছিল না। ইউরোপীয়দের অনেকেই নিজেদের সঙ্গে আনা রোগে প্রতিরোধী ছিল, কিন্তু আমেরিকানরা ছিল না। ফলে আমেরিকানদের মাঝে রোগ ছড়িয়েছে বাধাহীনভাবে।

কিন্তু আমেরিকা মহাদেশে সংক্রামক রোগ ছিল না কেন? কলেরার কথাই ধরা যাক। কলেরা একটি পানি বাহিত রোগ। মূলত আক্রান্ত রোগীর মল যদি খাবার পানিতে মিশে যায় তবে সেই পানি পান করলে সুস্থ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হবে। একটা সময় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত কলেরায়। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে আসত ‘ওলা বিবি’। কিন্তু এখানে এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা খেয়াল করার আছে। ওলা বিবি বা কলেরাকে চলতে থাকতে হবে। যদি একটি গ্রামেই কেবল কলেরা ছড়ায়, তবে গ্রামের মানুষ হয় মরে যাবে বা প্রতিরোধী হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে নতুন আক্রান্ত হবার কেউ না থাকলে মহামারী থেমে যাবে। কিন্তু যদি একটা শহরের কথা ভাবা হয়, সেখানে লাখ লাখ মানুষ গাদাগাদি করে থাকছে, প্রতিদিন নতুন শিশুর জন্ম হচ্ছে, গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে আসছে মানুষ। এক শহর থেকে অন্য শহরে যাতায়াত চলছে। কলেরার জন্য এর থেকে আদর্শ স্থান কী হতে পারে? সুপেয় পানির অভাবে লন্ডন ছিল এক সময় বিশ্বের কলেরা রাজধানী। ইউরোপজুড়ে মহামারীতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে শহরগুলোতেই। তাই প্রশ্নটির আরেকটু ভালো উত্তর হলো, আমেরিকা মহাদেশের ইউরোপের মত অস্বাস্থ্যকর এবং ঘনবসতি পূর্ণ শহর ছিল না।

কিন্তু ভারতবর্ষেও তো গ্রামগুলোতে ছড়িয়েছে মহামারী। অথবা ইউরোপীয়রা রোগ নিয়ে আসার পরেও, পুরো আমেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল রোগ। তাই অস্বাস্থ্যকর ঘনবসতির শহর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। তাছাড়া রোগের জীবাণু তো শহরে তৈরি হয়নি। তবে এই রোগের জীবাণু তৈরি হয়েছে কোথায়? 

জীবাণু কিন্তু তার পোষককে মেরে ফেলতে চায় না। পোষক মরে গেলে তার বংশ বিস্তার করার মাধ্যমই তো শেষ। মহামারীতে মানুষের মৃত্যু ঘটানো জীবাণুদের পক্ষ থেকে একটা ভুল হিসাবের ফল। কারণ জীবানুরা তো বুঝতে পারে না তারা মানুষের মধ্যে আছে- তাদের ধারণা তারা আছে পশুর মাঝে। হ্যাঁ, মানুষের জীবনঘাতি সংক্রামক রোগের আগমন পশুপাখি থেকে। 

হুপিং কাশি এসেছে শুকর থেকে, ফ্লু এসেছে শূকর ও পাখি (হাস মুরগী) উভয় থেকেই। আর গরু থেকে এসেছে মিজলস, যক্ষা, গুটি বসন্ত। গরু বা শূকরের জন্য এই রোগগুলো তেমন বড় বিষয় নয়- আমাদের জন্য এমনি ঠান্ডা লাগা যেমন তেমনই। কিন্তু যে গরুর জীবাণু গরুকে সামান্য করে, সেটাই মানুষকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতে পারে। তবে পশু থেকে মানুষে রোগ চলে আসা সম্ভাবনা কিন্তু খুবই কম। এজন্য যারা গৃহপালিত পশু প্রাণীর সাথে থাকেন তারা সবাই আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন না। কিন্তু মধ্যযুগীয় একটা অস্বাস্থ্যকর শহরে অসম্ভাব্য ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুন।

মধ্যযুগীয় ইউরোপিয়ান শহরে পশুপাখির বাস ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। গাড়ি টানার ঘোড়া থেকে শুরু করে মাংসের জন্য পোষা গবাদি পশুর বিচরণ ছিল শহরে যত্রতত্র। যেখানে-সেখানে পশুপাখির মলমূত্র ত্যাগ, উন্মুক্ত কসাইখানা এবং যে নদীতে মানুষ ও পশু পাখির বর্জ্য এবং মৃতদেহ ফেলা হচ্ছে, সেখান থেকেই খাবার পানি সংগ্রহ করা- নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। তাই আরও ভালো উত্তর হচ্ছে- সংক্রামক রোগগুলো প্রাণী থেকে আসে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা এত কম যে সম্ভাবনা বাড়াতে দরকার পড়ে অস্বাস্থ্যকর শহরের। যার সবকিছুই ছিল ইউরোপে।

কিন্তু লন্ডনের মত শহরে কেন গরু, শূকর ঘুরে বেড়াত? কেন আমেরিকান আদিবাসীদের শহর টেনোচিটলানে বেড়াত না? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের বুঝতে হবে বন্য পশু গৃহপালিত পশুতে কীভাবে পরিণত হয়? গৃহপালিত পশুকে প্রথমত মানুষের আয়ত্বে আনতে হয়।

আমেরিকা মহাদেশে মানুষের কাজে এমন পশু ছিল বাইসন বা মহিষ গোত্রীয় প্রাণীরা। কিন্তু এই পশুগুলোর বিরাট আকৃতি, শক্তিকে ও গতিকে হার মানানোর উপায় ছিল না। হরিণগুলোর শক্তি হয়ত বেশি নয়, কিন্ত বেশি দ্রুতগতির।  আরও মাথায় রাখতে হবে মে কালে আমেরিকা মহাদেশে কিন্তু ঘোড়াও ছিল না, যে ঘোড়ায় চড়ে তাড়া করা যাবে।

পুরো আমেরিকা মহাদেশের একমাত্র লামা-কেই গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত করতে পেরেছিল সেখানকার আদিবাসীরা। এই প্রাণীটির বিচরণ ছিল শধু দক্ষিণ আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ। এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকার ঘোড়া, গরু, শূকর, ভেড়া, ছাগল সেই তুলনায় অনেক বেশি শান্তশিষ্ট লেজ বিশিষ্ট চার পায়ের প্রাণী। অর্থাৎ এই অঞ্চলে পোষ মানানোর  মত প্রাণি ছিল অনেক। তাছাড়া পশুর পাল নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সঙ্গী ছিল ঘোড়া এবং কুকুর। বেশি গৃহপালিত প্রাণি মানে কার্যকর কৃষিকাজ, কার্যকর কৃষিকাজ মানে অনেক খাবার, অনেক খাবার মানে অনেক মানুষ, অনেক মানুষ মানে বড় শহর, আর শহর মানে এই এতসব গৃহপালিত প্রাণির এতসব রোগ মানুষের মধ্যে চলে আসার ভালো একটা সুযোগ দেওয়া। আর আমেরিকা মহাদেশে ঠিক উল্টোটা।

তাই ‘কেন আমেরিকা মহাদেশে সংক্রামক রোগ তৈরি হয়নি?’ প্রশ্নের এক কথায়, উত্তর হলো আমেরিকা মহাদেশে পোষ মানানোর মত প্রাণী ছিল না।

লেখক: শিক্ষার্থী, কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, দক্ষিণ কোরিয়া