পারমাণবিক ভর, সংখ্যা ও পর্যায় সারণী

রসায়নের প্রতিটা বইয়ে, ল্যাবে, ক্ল্যাসে একটা কমন ছবি থাকে, সেই ছবিটা নিজের দেওয়ালেও টাঙিয়ে রাখেন অনেক বিজ্ঞানপ্রেমী। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী নয় বা কখনো বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিলেন না, এমন লোকের কাছে ছবিটা নিছক কতগুলো বর্গক্ষেত্রের উচুনিচু এক টেবিল। কিন্তু এর ভেতরের যে সিম্ফনি, এর প্রতিটার পেছনে রয়েছে একেকটি ইতিহাস, তাই বিজ্ঞানরসিকের কাছে এটা এক মোহময়ী সুন্দরের ল্যান্ডস্কেপ যেন। পিরিয়োডিক টেবিল নামেই এর জগৎজোড়া খ্যাতি।  বাংলা নামটাও বেশ মিষ্টি- পর্যায় সারণী।

পর্যায় সারণীতে এত এত সৌন্দর্য, এটা কিন্তু একটা ভাষায় লেখা। সেই ভাষাটার জন্ম পরমাণুর গভীরে, নিউক্লিয়াসের অন্দরে। সেটার নাম পারমাণবিক সংখ্যা। নিছক সংখ্যা নয় কিন্তু। এই সংখ্যাগুলোর ভেতরেই লুকিয়ে আছে যেমন নিউক্লিয়ার ফিজিকসের প্রাণভোমরা, তেমনি এর ভেতরেই রয়েছে মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের বিল্ডিং ব্লক বা ইট। এই ইটেই তৈরি গোটা মহাবিশ্ব।

পর্যায় সারণীর জন্ম দেড় শ বছর আগে, রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্দেলিভের হাতে। আজকের যে পর্যায় সারণী আমরা দেখি, সেটা মেন্দেলিভের হুবহু সেই সারণী নয় ঠিকই, কিন্তু সেটার ফ্লেভারটা এখনো এর সঙ্গে মিশে আছে। মেন্দেলিভের পর্যায় সারণী ছিল পারমাণবিক ভরভিত্তিক, এখন সেটা পারমাণবিক সংখ্যা আর পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাসের ওপর দাঁড়িয়ে। 

কী এই পারমাণবিক সংখ্যা, কেনই বা এর জন্ম হলো?

এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে আরেকটা প্রশ্নের জবাব পেতে হবে। একই কণা দিয়ে তৈরি, তবু বস্তুতে বস্তুতে এত ফারাক কেন? কেন সব বস্তু একরকম নয়? প্রশ্নগুলো গ্রিক সভ্যতার যুগের। এসব প্রশ্নের বিচিত্র জবাব ছিল সেকালের দার্শনিকদের কাছে। বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক, ঐতিহাসিক, উপন্যাসিক আইজ্যাক আসিমভ যেমন প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে অনেক বই লিখেছেন, লিখেছেন পরামাণুর ইতিহাস ও বিজ্ঞান নিয়েও একটি আকর গ্রন্থ। ইনসাইড দ্য অ্যাটোম নামের সেই বইয়ে গ্রিক পরমাণুবাদের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন লেখক।

সব গ্রিক দার্শনিক পরমাণুবাদ মানতেন না। ডেমোক্রিটাস পরমাণুবাদের যে তত্ত্ব দেন, সেটা খারিজ করে দেন অ্যারিস্টটল। তিনি বলেন মাটি, আগুন, পানি আর বাতাসই হলো চারটি মৌলিক পদার্থ। এগুলো দিয়েই সব পদার্থ তৈরি।

যাঁরা ডেমোক্রিটাসের মত মানতেন, তাঁরা পরমাণুকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। কিছু পরমাণুর গঠন পানির পরমাণুর মতো। এগুলোর আকার গোলাকৃতির, তাই একে-অন্যের সংস্পর্শে এলে গড়িয়ে পড়ে যায়। এদের একসাথে থাকার প্রবণতা নেই বলেই চলে। কিছু পদার্থের পরমাণু আবার মাটির পরমাণুর মতো। সোনা, লোহা, সীসা ইত্যাদি হলো এই গোত্রের। এদের আকার ঘনকাকৃতির। তাই একটা পরমাণুর ওপর আরেকটা পরমাণু পড়লে গড়িয়ে পড়ে যায় না, বরং গায়ে গায়ে লেগে থাকে। সীসা আর সোনাকে মাটির আলাদা রূপ মনে করতেন গ্রিকরা। তেমনি সকল তরল হলো পানির একেকটি রূপ। সোনা, সীসা, লোহা যেহেতু মাটির পরমাণুর আলাদা আলাদা রূপ, তাই গ্রিক পণ্ডিতরা মনে করতেন, মাটিকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন করতে পারলে প্রথমে সীসা, তার পরে সোনায় পরিণত করা যাবে। এই যে এক পদার্থকে আরেকটি পদার্থে পরিণত করার এই তত্ত্ব, এটা নিয়েই মেতে ছিলেন পরবর্তীকালের অনেক রথীমহারথী। সেই চেষ্টার কালজয়ী রূপ দেন আরবীয় দার্শনিক, বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান। 

জাবির পৃথিবীর তাবৎ পদার্থকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। একভাগে ছিল মার্কারি, আরেক ভাগে সালফার। মার্কারি বা সালফার বলতে আমরা এখন যে মৌল দুটো বুঝি, জাবিরের মার্কারি আর সালফার তা নয়। এখানে মার্কারি ও সালফার হলো বস্তুর অবস্থা। এর জন্য তিনি দুটি মূলনীতি তৈরি করেন। মার্কারির মূলনীতি হলো, ভেজা ও ঠান্ডা। অর্থাৎ যেসব বস্তু ঠান্ডা কিংবা ভেজা সেগুলোকে তিনি মার্কারি গোষ্ঠীতে ফেলেন। অন্যদিকে শুকনো ও গরম বস্তুগুলোকে তিনি সালফার গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। জাবির মনে করতেন, ঠান্ডা, ভেজা, শুষ্ক ও গরম এই চারটি ধর্মই অ্যারিস্টোটলের চার মৌলিক পদার্থের বাইরে পদার্থের নতুন একটা অবস্থা নির্দেশ করে। এই চারটি ধর্মই মূল সাতটা ধাতুর জন্ম দেয়, সেগুলো হলো, সোনা, রুপা, সিসা, তামা, টিন, লোহা ও পারদ। মার্কারি-সালফার নীতির যে চারটি বৈশিষ্ট্য, এগুলোই ঠিক করে দেয় ধাতুর অবস্থা কেমন হবে। অর্থাৎ কোন ধাতু খুব সহজে গলে যাবে, কোন ধাতু ঘষা খেলে আগুনের স্ফূলিঙ্গ দেখা যাবে, ইত্যাদি ব্যাপারগুলো।  

গ্রিকদের মত জাবিরও মনে করতেন, মার্কারি-সালফার নীতি পরিবর্তন করে এক বস্তুকে আরেক বস্তুতে রূপান্তর করা যায় এবং সেই চেষ্টা করতে গিয়েই জন্ম দেন আলকামি নামে একটা শাস্ত্রের। এরই পরিমার্জিত রূপ হলো আধুনিক রসায়ন বা কেমিস্ট্রি। অনেক রথী-মহারথী এই শাস্ত্রের চর্চা করেন পুরো মধ্যযুগ জুড়ে। এর সর্বশেষ বিখ্যাত প্রতিনিধি হলেন, স্যার আইজ্যাক নিউটন। আলকেমির মূল লক্ষ্যই ছিল, এক মৌলিক পদার্থকে আরেক মৌলে পরিণত করা। বিশেষ করে সীসা কিংবা লোহাকে সোনায় পরিণত করার জন্য গোটা জীবনটায় ব্যয় করে ফেলেছিলেন অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি। কিন্তু তখন পর্যন্ত পরমাণু ধারণাটাই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরে আধুনিক রসায়ন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন আল কেমিস্টরা খামোকাই সময় নষ্ট করেছেন, এক মৌলকে কখনোই আরেক মৌলে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কিন্তু গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের পর বদলে যায় আগের ধারণা। আইসোটপ, তেজস্ক্রিয়তা, ফিশন, ফিউশন ইত্যাদি নিউক্লীয় ব্যাপারগুলো আবিষ্কার হওয়ার পর বদলে যায় ইতিহাস। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে যেমন এক পরমাণুকে আরেক পরমাণুতে পরিণত করা যায়, তেমনি তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে মৌলিক পদার্থগুলো প্রাকৃতিকভাবেই এক পদার্থ থেকে আরেক পদার্থে পরিণত হচ্ছে অহরহ। তাই বলে ভাববেন না, আল কেমিস্টরাই ঠিক ছিলেন। তাদের কাজকর্ম নিউক্লিয়ার ফিজিকসের ধারেকাছেও ছিল না। 

ষোড়শ শতাব্দীতে জাবির ইবনে হাইয়ানের মার্কারি-সালফার নীতিতে নতুন একটা নীতি যোগ করেন সুইস বিজ্ঞানী প্যারাসেলসাস। সেটা হল সল্ট বা লবণ নীতি। তিনি বলেন, শুধু ধাতু নয়, অন্য সব রাসায়নিক পদার্থই তৈরি হয় সালফার-মার্কারি নীতি মেনে। সত্যি বলতে কি, ওষুধ তৈরির ব্যাপারে প্যারাসেলসাসের বিশেষ আগ্রহ ছিল। এ কারণেই তিনি এই সল্ট নীতি যোগ করেন জাবিরের মার্কারি-সালফার নীতির সঙ্গে। সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে ফরাসী বিজ্ঞানী পিয়েরে গাসেন্ডি আবার ফিরিয়ে আনেন ডেমোক্রিটাসের পরমাণুর ধারনা। তার ওপর দাঁড়িয়েই রবার্ট বয়েল বাতিল করে দেন মার্কারি-সালফার-সল্ট নীতি। মূলত এখান থেকেই আধুনিক রসায়নের পথে একধাপ এগিয়ে যায় বিজ্ঞান। অন্যদিকে আলকেমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে আলকেমি থেকে রসায়নকে আলাদা করে ফেলেন ফরাসি বিজ্ঞানী অ্যান্টোনি ল্যাভোয়সিয়ে। তিনি তেত্রিশটা মৌলের একটা তালিকা তৈরি করেন। এরমধ্যে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, লোহা, সোনা, রুপা, টাংস্টেন ইত্যাদি তো ছিলই, চুনাপাথর আর বেরিয়াম হাইড্রোক্সাইডের মতো যৌগিক পদার্থকেও তিনি মৌল ভেবে তালিকায় ঠাই দেন। এমনকি আলো আর তাপ, যেগুলোকে এখন শক্তি হিসেবে জানে সবাই, ল্যাভোয়সিয়ে এ দুটিকেও মৌল বলে ভুল করেছিলেন। কিছু বিভ্রান্তি তৈরি হলেও, আধুনিক রসায়নের জন্মই হয়েছিল ল্যাভোয়সিয়ের হাতে। তাঁর কাছে হয়তো রসায়ন আরও অনেক কিছু পেত, কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের সময় তাঁকে অনেকটা বিনা দোষে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সেই নিভে যায় ল্যাভোয়সিয়ের জীবন-প্রদীপ। 

এর ঠিক পরপরই পরমাণু নিয়ে গবেষণায় মেতে উঠেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন ডালটন। ডালটন আধুনিক পরমাণুবাদ তত্ত্বের জনক। তিনি হিসাব করে দেখেছিলেন, পানির অণু, যেটাকে তিনি যৌগিক পরমাণু বলে মনে করতেন, তাতে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের ওজনের অনুপাত ৮:১। ডালটন ধরেই নিয়েছিলেন একটি হাইড্রোজেন পরমাণু আর একটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে পানির অণু তৈরি হয়। তখনকার বিজ্ঞানীদের জানা ছিল হাইড্রোজেন সবচেয়ে হালকা মৌল। তাই ডালটন পরামাণুদের ওজন বের করার চেষ্টা করেন। সেটা কেজিতে বা গ্রামে নয়। হাইড্রোজেন পরমাণুর ওজন এক ধরে অন্য পরমাণুর ওজন বের করা চেষ্টা করলেন তিনি। পানিতে যে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন থাকে, সেটা আলাদা করে দেখা গেল, তাতে যে পরিমাণ হাইড্রোজেন আছে, অক্সিজেন আছে তার ৮ গুণ। এটা অবশ্য ওজন করে হিসাব করা, আয়তনের দিক থেকে নয়। ওজন মানে কোন বস্তুর ওপর মহাকর্ষীয় প্রভাবের মান। কিন্তু ডালটন যেটা পারমাণবিক ওজন বলেছিলেন, সেটা আসলে পারমাণবিক ভর। ভর হল একটি বস্তুতে কী পরিমাণ পদার্থ আছে তার পরিমাপ। ভরের সাথে মহাকর্ষীয় ত্বরণ গুণ করলে তবেই ওজন পাওয়া যায়। যেহেতু পরমাণুদের ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব নিয়ে ডালটন মাথা ঘামাননি, সুতারাং তিনি যেটাকে পারমাণবিক ওজন বলছেন, ওটা ওজন হওয়ার কোনো কারণ নেই, ওটা ভর। পরে অবশ্য এটা সংশোধন করে পারমাণবিক ভরেই রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু পারমাণবিক ওজনের কথাটা এখনো হারিয়ে যায়নি। 

পানিতে অক্সিজেনের ভর হাইড্রোজেনের ভরের ৮ গুণ পেলেন ডালটন, তাই ধারণা করে নিলেন হাইড্রোজেন পরমাণুর পারমাণবিক ভর বা ওজন এক হলে, অন্যদিকে অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজন হবে ৮। হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরকে একক ধরে নেওয়া হলো, এর কারণ, পরমাণুদের ভর এখন যেভাবে কেজিতে বা গ্রামে বা ইলেকট্রন ভোল্টে প্রকাশ করা হয় তখন এইভাবে ভর পরিমাপের কোন সুযোগই ডাল্টনের কাছে ছিল না।

ডাল্টনের সমসাময়িক ও স্বদেশী বিজ্ঞানী উইলিয়াম নিকোলসন পারমাণবিক ভরের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলেন। এজন্য তিনি করেছিলেন একটি পরীক্ষা। একটা পাত্রে অ্যসিড মিশ্রিত পানির মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ চালনা করেন তিনি। এতে পানি থেকে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন আলাদা হয়ে যায়। ফলে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাসের বুদবুদ তৈরি হয় ওই মিশ্রণে। তিনি দুটি কাচ নলে গ্যাস দুটি সংগ্রহ করেন। কাচ নল দুটি খোলা মুখ ডোবানো ছিল অ্যাসিড মিশ্রিত পানিতে। যখন নলের ভেতর অক্সিজেন বা হাইড্রোজেন জমা হয় তখন ওপরের দিকটা ফাঁকা হতে শুরু করে এবং এসিড ও পানির মিশ্রণ নিচে নেমে আসে। নিকোলসন দেখেন অক্সিজেনের নলে যতখানি ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছে হাইড্রোজেন গ্যাসের নলে সেই ফাঁকা জায়গার পরিমাণ দ্বিগুণ। অর্থাৎ অক্সিজেনের দ্বিগুণ আয়তনের হাইড্রোজেন জমা হয়েছে কাচনলে। 

এটা কেন হলো? পরমাণুর ভর যাইহোক, সমান আয়তনের প্রতিটা গ্যাসে সমান সংখ্যক পরমাণু থাকে। বাইরে থেকে কোন চাপ প্রয়োগ না করলে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও চাপে একটা এক ঘনমিটার কাঁচের জারে যতগুলো হাইড্রোজেন পরমাণু থাকতে পারবে, ঠিক ততগুলো অক্সিজেন পরমাণু থাকতে পারবে। তেমনি ঠিক ততগুলো আর্গন, জেনন বা অন্য কোন গ্যাস থাকতে পারবে।

নিকোলসনের পরীক্ষায় দেখা গেল,

আ পানি থেকে যে আয়তনের অক্সিজেন নির্গত হয়েছে, হাইড্রোজেন নির্গত হয়েছে তার দ্বিগুণ। এ থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, পানির একটি অণুতে একটি অক্সিজেন ও দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু থাকে। তখন হিসাবটা কিন্তু উল্টে গেল। ডালটন বলেছিলেন, একটি অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজন একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ৮গুণ। সবটা যেহেতু পানি থেকে বের করা এবং তিনি পানিতে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের পরিমাণ সমান ধরে হিসাব করেছিলেন ডালটন, তাই এই ফলটা পেয়েছিলেন। নিকোলসন দেখালেন, পানিতে অক্সিজেনের থেকে হাইড্রোজেনের পরিমাণ দ্বিগুণ। কিন্তু কাচ নলে জমা হওয়া ওই গ্যাস দুটির ভর মেপে দেখা গেল, আয়তনে অর্ধেক হলেও অক্সিজেনের মোট ভর হাইড্রোজেনের ভরের আটগুন। তাই নিকোলসন সিদ্ধান্তে এলেন হাইড্রোজেনের পারমাণবিক ভর ১ হলে অক্সিজেনের হবে ১৬। নইলে ভর আর আয়তনের হিসেবে গড়মিল হয়ে যাবে। কিন্তু ডালটন নিকোলসনের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলেন না।

নিকোলসনের তত্ত্বকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী অ্যামাদিও অ্যাভোগেড্রো। যে কথাটি আমরা আগেই বলেছি- একই তাপমাত্রা ও চাপে সমান আয়তনের বিভিন্ন মৌলে সমান সংখ্যক পরামাণু থাকে। এই তত্ত্বটা পোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু অ্যাভোগেড্রো। সেটা ১৮১১ সালে। অবশ্য অ্যাভোগেড্রোর কাছেও কোন প্রমাণ ছিল না, সেটাও একটা অনুমান। তাই অ্যাভোগেড্রোর তত্ত্বকে তত্ত্ব না বলে প্রকল্প বলা হয়।

তত্ত্ব আর প্রকল্পের মধ্যে পার্থক্য আছে। তত্ত্বকে প্রমাণ হতেই হবে, না হলে বাতিল হয়ে যাবে। প্রকল্প যদি প্রমাণিত নাও হয়, পরে সেটাকে পরিবর্তন করা বা বাতিল করার সুযোগ থাকবে। অ্যাভোগেড্রো প্রকল্পের আরেকটা সাফল্য ছিল। তিনি গণহারে সব বস্তুর সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণাকে পরমাণু নাম দেননি। মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার নাম তিনি দেন পরমাণু এবং ডালটন যেটাকে যৌগিক পরমাণু বলেছিলেন, অর্থাৎ যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার নাম অ্যাভোগেড্রো  দিলেন অণু বা মলিকুল।

ডালটন তখন প্রভাবশালী বিজ্ঞানী, পরমাণুবাদের তত্ত্ব দিয়ে নাম করেছেন। গণিতজ্ঞ হিসেবেও বিজ্ঞান জগতে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব। সুতরাং নিকোলসনের হিসাব কিছুদিন কোণঠাসা হয়ে থাকল। তবে বিজ্ঞান বরাবরই সত্যের জয়গান গায়। নিউটন-আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীরা যেমন বড় বড় সব তত্ত্ব দিয়ে নিজেদেরকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, তেমনি তাঁরাও ভুল করেছেন। সেই ভুল যখন অন্যরা ধরেছে, প্রথমে কেউ মানতে চায়নি। পরে হয়তো আরেক কোনো গবেষক এসে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তেমনি নিকোলসনের পক্ষে তখন ঢাল ধরেন সুইডিশ বিজ্ঞানী জন জ্যাকব বার্জেলিয়াস। তিনি বললেন, নিকোলসনের কথাই ঠিক। অর্থাৎ হাইড্রোজেনের পারমাণবিক ওজন ১ হলে অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজন হবে ১৬। বার্জেলিয়াস এখানেই থামলেন না। তিনি অন্যসব গ্যাসীয় মৌল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। তৈরি করলেন তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবগুলো মৌলের তালিকা। তালিকা ডালটনও করেছিলেন, স্বভাবতই ডাল্টনের চেয়ে বার্জেলিয়াসের তালিকায় বেশি উন্নত ছিল।  মোটামুটি ১৮২৮ সালে পারমাণবিক ওজনের তালিকাটি প্রকাশ করেন বার্জেলিয়াস।

বার্জেলিয়াস সেই তালিকা প্রকাশ করার পর গ্রিক যুগের সেই পুরনো প্রশ্নের উত্তর বেরিয়ে এল- কেন একটা মৌলের পরমাণু থেকে আরেকটা মৌল পরমাণু আলাদা? উত্তর হলো, এদের পারমাণবিক ওজন আলাদা বলেই বাহ্যিক চেহারা কাঠামো সম্পূর্ণ আলাদা। বার্জেলিয়াসের এই তালিকাই অবশ্য শেষ কথা নয়। কিন্তু এর সফলতা ছিল ব্যাপক। প্রায় এক শতাব্দী ধরে রসায়নবিদদের সহযোগিতা করেছে এই তালিকা।

বার্জেলিয়াসের আগে ১৮১৭ সালে জার্মান বিজ্ঞানী জোহান উলফগ্যাং ডোবারনিয়ার রাসায়নিক মৌলদের মধ্যে এটা ছন্দ আবিষ্কার করেন। তিনি খেয়াল করেন, তিনটি মৌলের একটি গ্রুপের ভেতর পারমাণবিক ওজনের বিন্যাস ও ওজনের মধ্যে একটা ছন্দ আছে। যেমন লিথিয়াম, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম, এরা প্রত্যেকেই ক্ষারধাতু। এদের পারমাণবিক ভর যথাক্রমে ৭, ২৩ ও ৩৯। ডোবারনিয়ার লক্ষ্য করলেন, এদের মধ্যে লিথিয়াম আর পটাশিয়ামের পারমাণবিক ওজনের গড় করে যে সংখ্যাটা পাওয়া যায়, সেটাই হলো সোডিয়ামের পারমাণবিক ওজন। অর্থাৎ (৭+৩৯)/২ = ৪৬/২ = ২৩। তিনি ধর্মে ও বৈশিষ্ট্যে মিল আছে এমন আরও কিছু মৌলের পারবাণবিক ভরের ক্ষেত্রে এই ছন্দটা খুঁজে পেলেন। বার্জেলিয়াস ডোবারনিয়ারের এই কাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরে আরও অনেক বিজ্ঞানী রাসায়নিক মৌলদের মধ্যে এমন ছন্দ খুঁজে পেলেন। এই ছন্দই পরে আধুনিক পর্যায় সারণির ভিত তৈরি করে দিয়েছিল।

১৮৬০ সাল। জার্মানির কার্লশ্রুতে প্রথমবারের মতো বসে রসায়নবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সেই সম্মেলনে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী স্টানিসলাস ক্যানিজারো অ্যাভোগেড্রোর প্রকল্পটিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, অ্যাভোগেড্রো প্রকল্প সফলতা অন্য জায়গায়। এটি শুধু পানিতে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের পরিমাণ নির্দেশ করে না, যেকোনো অণুতে পরমাণু সংখ্যা বের করার জন্য এই প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পারমাণবিক ওজনের জন্য এ প্রকল্প বড়োসড়ো আশীর্বাদ। ক্যানিজারোর এ ভাবনা আরো দুবছর আগের অর্থাৎ ১৮৫৮ সালের। 

১৮৬৫ সালে বেলজিয়ান পদার্থবিদ জ্যাঁ সারভা স্ট্যাস নতুন করে পারমাণবিক ওজনের তালিকাটি প্রকাশ করেন। বার্জেলিয়াসের পারমাণবিক ওজনের তালিকাটি আরো সূক্ষ্মভাবে সম্পাদন করেন স্ট্যাস। পারমাণবিক ওজন ধরে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটু পরিবর্তন আনেন তিনি। হাইড্রোজেনের পারমাণবিক ওজন ১ ধরলে অনেক পরমাণুর ক্ষেত্রেই পারমাণবিক ভরকে পূর্ণ সংখ্যায় পাওয়া যায় না। এমনকি হাইড্রোজেনের পারমাণবিক ওজন ১ ধরলে ধরলে অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজন ১৬-এর চেয়ে কম হয়। কিন্তু অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজন বা ভর ১৬ ধরে হিসাব করলে হাইড্রোজেনের পারমাণবিক ওজন এক হয় না, সামান্য বেশি হয়। তবে বেশিরভাগ মৌলের পারমাণবিক ওজনের হিসাবটা পূর্ণসংখ্যার কাছাকাছি থাকে। তাই স্টাস অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজন ১৬ ধরেই তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবগুলো মৌলের পারমাণবিক ওজনের একটি তালিকা তৈরি করলেন। 

১৮৬৯ সালে পারমাণবিক ওজনের ভিত্তিতে রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্দেলিভ একটা সত্যিকারের তালিকা তৈরি করেন। এই তালিকায় পারমাণবিক ওজনের ভিত্তিতে শুধু মৌলগুলো পর পর সাজানো হয়নি। বরং ধর্ম ও বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে মৌলিক পদার্থগুলোকে কয়েকটি কলাম ও সারিতে বিন্যাস্ত করেছিলেন তিনি। একই কলামের ওপর-নিচে বসা মৌলগুলোর ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য যেমন মিল আছে, তেমনি এক সারিতে পাশাপাশি বসা মৌলগুলোর মধ্যে ধর্মে ও বৈশিষ্ট্য মিল পাওয়া যায়। একটা সারি শেষ হওয়ার পর তার নিচে নতুন একটা সারি শুরু হয়। কারণ প্রথম কলামের প্রথম মৌলটির ধর্ম যেমন তার নিচে বসা নতুন সারির প্রথম মৌলটির ধর্ম ও বৈশিষ্ট্যও তেমন। মৌলের পর্যায়ভিত্তিক ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য ফিরে আসার এই যে ছন্দ, একারণেই তালিকার নাম দেওয়া হয় পর্যায় সারণি বা পিরিয়োডিক টেবিল।

পারমাণবিক ওজনের ভিত্তিতে মেন্দেলিভ তৈরি করেছিলেন এই পর্যায় সারণি। সেই পারমাণবিক ওজনের হিসাব থেকেই তিনি কিছু ঘর খালি রেখেছিলেন পর্যায় সারণিতে। কারণ, কিছু মৌলের খোঁজ তখনো পাননি বিজ্ঞানীরা। সেই জায়গাগুলো অন্য কোন পরমাণু দিয়ে ভরে দেননি মেন্দেলিভ। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল, এই খালি ঘরগুলো একসময় পূর্ণ হয়ে যাবে। সেটা ছিল একটা ভবিষ্যদবাণী; পারমাণবিক ওজনের ভিত্তিতে করা। যে ফাঁকা ঘরগুলি রেখেছিলেন, তার মধ্য থেকে তিনটি বেছে নিয়ে সেগুলোর ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য কেমন হতে পারে তার আগাম ধারণা দেন মেন্দেলিভ। সেটা ১৮৭১ সালের কথা। এই তিনটি মৌলের নাম তিনি দেন একা-অ্যালুমিনিয়াম, একা-বোরন ও একা-সিলিকন। অ্যালুমিনিয়, বোরন ও সিলিকনের অস্তিত্ব আগেই ছিল। মেন্দেলিভ এগুলোর সঙ্গে সংস্কৃত শব্দ ‘একা’- বাংলায় যার অর্থ এক- জুড়ে দিলেন। তিনি বললেন, একা-অ্যালুমিনিয়ামের পারমাণবিক ওজন হবে ৬৮, একা-বোরনের ৪৪ এবং একা সিলিকনের ৭২। বেশিদিন লাগেনি। ১৮৭৫ সালে ফরাসী বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন একা-অ্যালুমিনিয়াম, যার পারমাণবিক ভর পাওয়া গেল ৬৯.৭। এর নতুন নামকরণ করা হলো গ্যালিয়াম। এরপর ১৮৭৯ সালে আবিষ্কার হলো একা বোরণের কাছাকাছি পারমাণবিক ওজনের মৌল স্ক্যান্ডিয়াম। পারমাণবিক ওজন পাওয়া গেল ৪৫। ১৮৮৫ সালে আবিষ্কার হলো ৭২.৬ পারমাণবিক ওজনের মৌল গ্যালিয়াম, যেটাকে মেন্দেলিভ নামকরণ করেছিলেন একা-সিলিকন। হুবহু মেন্দেলিভের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে মেলেনি এই মৌল তিনটির পারমাণবিক ওজন। কিন্তু কাছাকাছি ছিল। তবে বৈশিষ্ট্য ধর্ম যেমনটা পাওয়া গিয়েছিল মেন্দেলিভের ভবিষ্যদ্বাণীতে, তেমনটাই পাওয়া গেল। 

মেন্দেলিভের পর্যায় সারণীর দুর্বলতা অন্য জায়গায়। মেন্দেলিভ পরমাণুকে অবিভাজ্য ধরেই এদের পারমাণবিক ওজনের ভিত্তিতে পর্যায় সারণি তৈরি করেছিলেন। ঝামেলা হয়ে গেল ১৮৯৯ জে জে টমসন ইলেকট্রন আবিষ্কারের পর। আরেকটা ঝামেলা হলো যোজনী নিয়ে। কোনো মৌল যৌগ গঠনের সময় কয়েকটি রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে সেটাকেই ওই মৌলের যোজনী বলে। বেশিরভাগ মৌলের ক্ষেত্রেই যোজনী ১,২ ইত্যাদি। কিন্তু নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোর সক্রিয়তা অত্যন্ত কম, প্রায় নেই বললেই চলে। পারতপক্ষে এরা অন্য কোনো মৌলের সাথে যুক্ত হয়ে যৌগ গঠন করে না বললেই চলে। যদিও আধুনিক রসায়নে দেখা গেছে, কিছু কিছু নিষ্ক্রিয় মৌল যৌগ গঠন করে। কিন্তু সেকালে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের যোজনী শূন্য বলেই ধরা হত। আর যোজনী শূন্য হলে পর্যায় সারণিতে তার অবস্থান কোথায়, এর ব্যাখ্যা মেন্দেলিভের পর্যায় সারণিতে ছিল না। আরেকটা বড় ত্রুটি ছিল ওটাতে। মেন্দেলিভ নিজেই বলেছিলেন, মৌলের পারমাণবিক ওজন যত বেশি তার স্থান পর্যায় সারণিতে ততো পরে। অথচ তিনি নিজেই এই আইনের লংঘন করেছিলেন। সেটা টলুরিয়াম ও আয়োডিনের ক্ষেত্রে। টলুরিয়ামের পারমাণবিক ওজন ১২৭.৬, অন্যদিকে আয়োডিনের পারমাণবিক ওজন ১২৬.৯। কিন্তু কিছু কিছু ধর্মের ওপর ভিত্তি করে মেন্দেলিভ পর্যায় সারণিতে টলুরিয়ামকে আয়োডিনের আগেই স্থান দিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, এই দুটি মৌলের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য বলছে টলুরিয়য়াম আগে বসবে। কিন্তু টলুরিয়ামের পারমাণবিক ওজন বেশি পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মেন্দেলিভের যুক্তি ছিল, এটা ঠিক নয়, টলুরিয়াম আর আয়োডিনের পারমাণবিক ওজন নির্ণয় করতে নিশ্চয়ই কোন ভুল হয়েছে বিজ্ঞানীদের। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই ভুল বের করা যায়নি। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে ঠিক ছিলেন, ভুল করেছিলেন মেন্দেলিভ নিজে।

তবে সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হলো পরমাণুর অবিভাজ্যতা নিয়ে। টমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করার পর বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন, পরমাণু অবিভাজ্য নয়। তারপর দেড় দশকের মধ্যে রাদারফোর্ড প্রমাণ করে দিলেন পরমাণুর ভেতর শুধু ইলেকট্রন নয়, আছে প্রোটনও। রাদারফোর্ড, নীলস বোর আর সোমারফিল্ডরা মিলে পরমাণুর একটি মডেল তৈরি করলেন। তাতে দেখা গেল ধনাত্মক আধানবিশিষ্ট নিউক্লিয়াস আর এর বাইরে বিভিন্ন কক্ষ পথে ঘূর্ণ্যমান ইলেকট্রন তৈরি হয় পরমাণু।

কিন্তু পরমাণুতে ইলেকট্রনের কমবেশি হতে পারে, কারণ আয়নিত পরামাণুগুলিতে ইলেকট্রন কমও থাকতে পারে। তাই তখন একটু ঘুরিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীরা জন্ম দিলেন পারমাণবিক সংখ্যার। প্রতিটা পরামাণুর একটি করে পারমাণবিক সংখ্যা আছে, সেই সংখ্যাটা হলো পরমাণুতে থাকা প্রোটন সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। তাছাড়া পারমাণবিক ভরের ক্ষেত্রে আরও একটা সীমাবদ্ধ ছিল। সেটা প্রকট হয় নিউট্রন আবিষ্কারের পর। তারে মানে পরমাণুতে ইলেকট্রন কিংবা প্রোটন সংখ্যা দিয়েই পারমাণবিক ভরের হিসাব করলে চলে না। নিউট্রনের ভরকেও আমলে নিতে হবে। তখন এল পারমাণবিক ভর সংখ্যার ব্যাপার-স্যাপার। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যে প্রোটন আর নিউট্রন সংখ্যা থাকে। বিজ্ঞানীরা এদের মিলিত সংখ্যার নাম দিলেন পারমাণবিক সংখ্যা। যেমন অক্সিজেনের পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ৮টা প্রোটন ৮টা নিউট্রন আছে। তাই পারমাণবিক ভর সংখ্যা  ৮+৮ = ১৬। এই পারমাণবিক ভর সংখ্যা দিয়ে কি পর্যায় সারণী সাজানো যায়? যায়, কিন্তু তাতেও একটা ঝামেলা ছিল। সেটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। কারণ ততদিনে ততোদিনে তেজস্ক্রিয় পদার্থ আবিষ্কার হয়ে গেছে। আবিষ্কার হয়েছে আইসোটোপ। 

আইসোটো আবার কি জিনিস? ধরা যাক কার্বন পরমাণুতে ৬টা নিউট্রন এবং ৬টা প্রোটন থাকে। তাই কার্বনের পারমাণবিক ভর সংখ্যা ১৪। কিন্তু সব সময় এই সংখ্যাটা সমান থাকে না। দেখা গেছে কিছু কিছু পরমাণুতে প্রোটন সংখ্যা সমান হলেও নিউট্রন সংখ্যা কম বা বেশি হয়। এতে পরমাণু তেজস্ক্রিয় ধর্ম প্রকাশ পায় ঠিকই, কিন্তু সেটার ভরসংখ্যা ঠিক থাকে না। ১৪ ভরসংখ্যার কার্বন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ৬টা প্রোটনের সাথে ৮টা নিউট্রন। তাই এর ভর সংখ্যা ১৪। অন্যদিকে নাইট্রোজেনের নিউক্লিয়াসে ৭ প্রোটন ও ৭টা নিউট্রন থাকে। তাই নাইট্রোজেনের ভর সংখ্যা ১৪। কার্বন ১৪ আর নাইট্রোজেন ১৪-এর ঝামেলা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভরসংখ্যাভিত্তিক পর্যায় সারণি তৈরিতে। তখন অন্য পথে হাঁটতে হয় বিজ্ঞানীদের। আবার পরমাণুতে ইলেকট্রন সংখ্যা সব সময় সমান থাকে না বলে সেটা নিয়েও পর্যায় সারণি তৈরি করা সম্ভব নয়। 

তখন ব্রিটিশ পদার্থবিদ হেনরি মোসলে নতুনভাবে উদ্যোগ নিলেন। তিনি পারমাণবিক সংখ্যার ভিত্তিতে পর্যায় সারণি তৈরি করার প্রস্তাব দিলেন। 

পারমাণবিক সংখ্যাটা আবার কী? 

আমরা পারমাণবিক ভর সংখ্যার কথা জেনেছি, পারমাণবিক সংখ্যাটা ভরসংখ্যার অর্ধেকের কাছাকাছি। একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যে কয়টি প্রোটন আছে তাকে সেই মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ছয় বলা হয়। প্রতিটা মৌলের পরমাণুতে প্রোটন ও ইলেকট্রন সংখ্যা সমান। তাহলে পারমাণবিক সংখ্যা কেন ইলেকট্রন সংখ্যা নয়, প্রোটন সংখ্যা হলো। আসলে ইলেকট্রন পরমাণুর একেবারে স্থায়ী সদস্য। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় আয়নিত করে পরমাণুর ভেতর থেকে ইলেকট্রন সরিয়ে ফেলা যায়। তাই ইলেকট্রন সংখ্যাকে পারমাণবিক সংখ্যা না ধরে প্রোটন সংখ্যাকেই পারমাণবিক সংখ্যা হিসেবে দেখানো হয়।

প্রোটন সংখ্যাভিত্তিক পর্যায় সারণি তৈরি করার চিন্তাটা প্রথমে মোসলের মাথায় আসেনি। এসেছিল তার এক অর্থনীতিবীদ এবং শখের পদার্থবিদ বন্ধু অ্যান্টোনি ফন বেন ব্রোয়েকের মাথা থেকে। তিনিই মোসলেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন নিউক্লিয়াসের চার্জে ওপর ভিত্তি করে পর্যায় সারণি তৈরি করার। কিন্তু এর জন্য তো একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তি হাজির করতে হবে। সেই কাজটি করলেন হেনরি মোসলে। তিনি বিভিন্ন পরমাণুর ওপর এক্স-রশ্মির বর্ণালিবীক্ষণ করলে। বিভিন্ন মৌলের থেকে পাওয়া এক্স-রশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য মেপে দেখালেন, এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বস্তুর পারমাণবিক সংখ্যার ওপর অর্থাৎ প্রোটন সংখ্যার ওপর নির্ভর করে। সুতরাং প্রোটন সংখ্যাকে ভিত্তি করে পর্যায় সারণি তৈরি করাই যায় এবং তিনি সেটা করেও দেখালেন। 

পরমাণুর নিউক্লিয়াসে চারপাশে যে ইলেকট্রনের বিন্যাস, সেগুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেরিয়ে এল থলের বিড়াল। বিজ্ঞানীরা জানতেন না এতদিন পর্যায় সারণিতে একই গ্রুপে মৌলগুলোতে পারমাণবিক ওজনের অনেক পার্থক্য থাকলেও কেন তাদের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য একই রকম হয়? এই প্রশ্নের উত্তর বেরিয়ে এলো পারমাণবিক মডেল থেকে। রসায়ন বিজ্ঞানীরা যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হাপিত্যেশ করেছেন, তার উত্তর দিলেন না পদার্থবিজ্ঞানীরা। তারা দেখালেন, নিউক্লিয়াসের চারপাশে বিভিন্ন শক্তিস্তরে যে ইলেকট্রন বিন্যাস, তার ভেতর একটা ছন্দ আছে। ইলেকট্রন বিন্যাসই ঠিক করে দেয় মৌলগুলো পর্যায় সারণি কোন গ্রুপে এবং কোন স্তরে বসবে। সুতরাং পারমাণবিক ওজনের ভিত্তিতে তৈরি করা মেন্দেলিভের পর্যায় সারণিতে অনেক ফাঁকফোকর বেরিয়ে এল। তখন পর্যায় সারণী সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। সংশোধনও হলো, ইলেকট্রন বিন্যাসের ওপর ভিত্তি করে পরামাণুগুলোকে সাজানো হলো পর্যায় সারণীতে। এজন্য কোয়ান্টাম বলবিদ্যার দারস্থ হয়েছিলেন পদার্থবিদেরা। 



লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: পর্যায় সারণীর শেষ কোথায়/ইবরাহিম মুদ্দাসসের এবং মেন্দেলিভের পর্যায় সারণী/আবুল বাসার/বিজ্ঞানচিন্তা, মার্চ ২০১৯, ইনসাইড দ্য অ্যাটোম/আইজ্যাক আসিমভ