হাইপেশিয়া: প্রথম নারী গণিতবিদ

নারী মানে ঘরের শোভা, সংসারের কাজকর্ম করবে, বাচ্চা-কাচ্চা লালন করবে- একসময় এমনটাই ভাবা হতো। কিন্তু সব নারী তো এক নয়। জ্ঞানচর্চার অধিকার তাঁদেরও আছে। আছে বিশ্বসভ্যতায়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের অধিকারও। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে প্রাচীন যুগের হাতে গোনা কয়েকজন নারী জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। এজন্য চরম মাশুল গুণতে হয়েছে তাঁদের। সেই মহিয়শীদেরই একজন হাইপেশিয়া। হাইপেশিয়ার উত্থান যেমন রোমাঞ্চকর, তাঁর বিদায়ও তেমনি মর্মান্তিক ও ভয়ংকর।

হাইপেশিয়ার জন্ম মিশরের আলেকজেন্দ্রিয়ায়, ৩৫০ সালে (মাতান্তরে ৩৭০ সালে)।  তবে তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ, দার্শনিক ও আলেকজেন্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থিওন। বাবার কাছেই হাইপেশিয়ার শিক্ষার হাতে খড়ি। বাবার ইচ্ছাতেই হাইপেশিয়া দর্শন ও গণিতশাস্ত্রের চর্চা শুরু করেন। দ্রুতই এসব বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করে। 

থিওন আলেকজেন্দ্রিয়ার শিক্ষক, তাই হাইপেশিয়া সহজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে যাতায়াত করতে পারতেন। তিনি প্লেটো-সক্রেটিসদের মত বড় বড় গণিতবিদ এবং দার্শনিকদের অসংখ্য বই পড়ে ফেলেন। এতেই তাঁর গণিত ও দর্শনে দক্ষতা সেকালের অনেক পণ্ডিতকেও ছাড়িয়ে যায়। সাহায্য করেন বাবার গবেষণাতেও। একসময় জ্ঞানে-গণিতে বাবাকেও ছাড়িয়ে যান হাইপেশিয়া। ইতিহাস তাই থিয়নকে যতটা পণ্ডিত হিসেবে চেনে, তারচেও বেশি চেনে হাইপেশিয়ার বাবা হিসেবেই।

বাবার পরামর্শে হাইপেশিয়া রোমান সাম্রাজ্য ঘুরতে বের হন। উদ্দেশ্য ভূগোল ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা। একসময় এথেন্সে হাজির হন। গণিতের শিক্ষক হিসেবে গণিত পড়ানোর সুযোগ পান একটি বিদ্যালয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি শিক্ষক হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এ খবর পৌছে যায় আলেকজেন্দ্রিয়ায়। ফলে আলেকজেন্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রস্তাব আসে অধ্যাপনার। হাইপেশিয়া আলেকজেন্দ্রিয়ায় ফিরে আসেন। 

হাইপেশিয়ার অসাধারণ পাণ্ডিত্য দেখে আলেকজান্দ্রিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় তাকে নিওপ্লেটনিক স্কুলের প্রধান নিযুক্ত করেন। সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞের পদ তো আছেই। হাইপেশিয়া হয়ে ওঠেন আলেকজেন্দ্রিয়ার সবার সেরা শিক্ষক। তিনি গণিত, দর্শন ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা জটিল বিষয় সহজ করে ছাত্রদের বোঝাতে পারতেন। দূর-দূরান্ত থেকে তাই শিক্ষার্থীরা চলে আসত তাঁর বক্তৃতা শুনতে। সন্ধ্যার পর আলেকজেন্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে সবার জন্য বক্তৃতা দিতেন। দর্শনীর বিনিময়ে প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী তাঁর বক্তৃতা শুনত। হাইপেশিয়া তাঁর বক্তৃতায় প্লেটো, আ্যারিস্টটলের দর্শন প্রচার করতেন। এভাবেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে হাইপেশিয়ার নাম। 

হাইপেশিয়া বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। তার বাবাকে জ্যামিতির কালজয়ী গ্রন্থ ইউক্লিডস এলিমেন্টস-এর নতুন সংস্করণ তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন। এই সংস্করণটি বেশ কিছু অংশ বর্তমানে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহৃত হয়। বাবার সঙ্গে যৌথভাবে টলেমির আলমাজেস্ট এবং নিজে দায়োফ্যান্তাসের লেখা অ্যারিথমেটিকা বই নিয়েও কাজ করেন। তিনি অ্যাস্ট্রল্যাব নামে একটি যন্ত্রও উদ্ভাবন করেছিলেন। এই যন্ত্রটি গ্রহ-নক্ষত্রের দৈনন্দিন ঘূর্ণন গণনায় ব্যবহৃত হত। তাঁর আবিষ্কৃত অন্য যন্ত্রটি হাইড্রোস্কোপ। এটা দিয়ে মাপা যেত তরল পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্ব। এছড়া তিনি পানির লেভেল মাপার জন্যও একটি যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, হাইপেশিয়া স্যুডা নামে একটি বই লিখেছিলেন। তবে তাঁর কোন লেখাই অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়নি।

বিপুল জনপ্রিয়তাই হাইপেশিয়ার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ৪১৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাস। অন্যান্য দিনের মতো হাইপেশিয়া লাইব্রেরির উদ্দেশ্য রওনা হয়েছেন। পিটার নামের এক ব্যক্তি অনেক দিন ধরে নজর রাখছিল হাইপেশিয়ার ওপর। সেদিন হাইপেশিয়ার গাড়ি এগিয়ে চলছে। হঠৎ পিটার ও তাঁর দলবল হাইপেশিয়াকে গাড়ি থেকে নামিয়ে টানতে টানতে কেসারিয়াম নামের এক চার্চে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ভয়ঙ্কর অত্যাচার করে হত্যা করা হয়। তারপর পুড়িয়ে ফেলা হয় তার খণ্ডিত দেহ। ঐতিহাসিকদের মতে, পিটার ও তাঁর দলবল আলেকজেন্দ্রিয়ার বিশপ সিরিলের লোক ছিলেন। তবে সিরিল নিজ মুখে হাইপেশিয়ায়কে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন কিনা তা জানা যায়নি।

হাইপেশিয়ার মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয় আলেকজান্দ্রিয়ার গবেষণার অধ্যায়। তারপরেই অন্ধকার যুগ নামে ইউরোপে। পশ্চিমা বিশ্বে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান আর বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় উল্লেখযোগ্য কোন উন্নতি হয়নি এরপরের ১ হাজার বছরে। তাই ধারণা করা হয় হাইপেশিয়াই ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর শেষ গবেষক ও শিক্ষক। 

২০০৯ সালে হাইপেশিয়ার মর্মান্তিক কাহিনী অবলম্বনে হলিউডে তৈরি হয় অ্যাগোরা  নামে একটি সিনেমা। হাইপেশিয়ার নামে চাঁদের দুইটি গর্তের নামকরণ করা হয়েছে। একটির নাম হাইপেশিয়া। অন্যটি রিমে হাইপেশিয়া। যতদিন আকাশে চাঁদ উঠবে ততদিন থাকবে হাইপেশিয়ার নাম।   

হাইপেশিয়া ছিলেন গণিতে পর্যাপ্ত অবদান রাখা ইতিহাসের প্রথম নারী। ইউক্লিডের পরে হাইপেশিয়ার মত এত বড় গণিতজ্ঞ আলেকজেন্দ্রিয়ায় জন্ম হয়নি। মার্গারেট অ্যালিক তাঁর হাইপেশিয়া হেরিটেজ গ্রন্থে তাঁকে বলেছেন মাদাম কুরির আগে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নারী বিজ্ঞানী। 

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারী তিতুমীর কলেজ, ঢাকা 

সূত্র: ম্যাথ হিস্ট্রি ডট এসটি