পদার্থের কত বিচিত্র দশা!

স্কুলেই আমরা শিখি, পদার্থের তিন অবস্থা—কঠিন, তরল আর বায়বীয় (বা গ্যাসীয়)। তাপমাত্রা বাড়ালে এক অবস্থা থেকে পদার্থ আরেক অবস্থায় রূপান্তরিত হয়। যেমন: বরফ গললে পানি পাই। পানির তাপমাত্রা খানিকটা বাড়ালে সেই পানিই আবার জলীয় বাষ্পে রূপ নেয়। এটা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের অংশ, কারণ এ ধরনের পরিবর্তন আমরা প্রতিদিনই দেখি। মানুষের প্রযুক্তিগত জ্ঞান দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডারটিও সমৃদ্ধ হতে থাকে। আমরা উচ্চ তাপমাত্রা, অত্যন্ত নিম্নচাপে পদার্থকে পরীক্ষা করে নতুন এক দশার সঙ্গে পরিচিত হলাম, যার নাম প্লাজমা। এটা আদতে গ্যাসীয় অবস্থার মতো মনে হলেও সাধারণ গ্যাসের সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। গ্যাসের বৈদ্যুতিক চার্জ অণুর মাঝেই আবদ্ধ থাকে। কিন্তু প্লাজমায় চার্জগুলো মুক্ত অবস্থায় থাকে। এ কারণে প্লাজমায় চার্জের প্রবাহ আর আয়নের প্রবাহ ভিন্ন। পৃথিবীতে আমরা এই প্লাজমার সাধারণ আধিপত্য না দেখলেও মহাবিশ্বে পদার্থের বেশির ভাগই এই প্লাজমা দশায় নীহারিকা ও নক্ষত্রগুলোর মাঝে ছড়িয়ে আছে।

পদার্থের নতুন দশা কিন্তু শুধু উচ্চ তাপমাত্রাতেই মেলেনি—বিজ্ঞানীরা নিম্ন তাপমাত্রায়ও পদার্থের বিচিত্র সব অবস্থা দেখতে পেয়েছেন। ১৯১১ সালে হেইকে কামারলিং ওনেশ পারদের অতিপরিবাহিতা আবিষ্কার করেন। হিলিয়ামকে তরল করে (এই তরলীকরণ প্রক্রিয়া তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন) সেটা দিয়ে পারদকে শীতল করে তার ওপর তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। দেখেন, ‘পারদ একটি নতুন দশায় উপনীত হয়েছে। আর এর অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক গুণাবলিকে এখন থেকে অতিপরিবাহিতা বলে ডাকা যেতে পারে। কিন্তু কী দেখেছিলেন ওনেশ? ওই সময়ে লর্ড কেলভিনের মতো বাঘা বিজ্ঞানীদেরও ধারণা ছিল—তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে পদার্থের মাঝে চার্জের গতি হ্রাস পায়। তাহলে অতি স্বল্প তাপমাত্রায় চার্জ আর পরিবাহিত হবে না—সব পদার্থের রোধ দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। ওনেশ এই ধারণার ঠিক বিপরীতে দেখলেন যে পরম শূন্য তাপমাত্রায় পৌঁছার প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস আগেই পারদের রোধ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এটাকেই তিনি অতিপরিবাহিতা বলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ওনেশ এ রকম অতিপরিবাহিতা টিন ও সিসাতেও দেখতে পেয়েছিলেন। বর্তমানে আমরা অতিপরিবাহিতার সংজ্ঞা এই শূন্য রোধের মাধ্যমে দিই না।

পদার্থের আরেকটা উদ্ভট ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করা যায় ওনেশেরই আবিষ্কৃত এই তরল হিলিয়ামে। তবে এটি পিওতর কাপিত্সা, জন এলেন ও ডন মিসেনার আবিষ্কার করেন ১৯৩৭ সালে। সাধারণ তরলের সান্দ্রতা থাকে। এ কারণে টমেটো সস বা গ্লিসারিন দ্রুত বোতল থেকে গলগল করে বেরোয় না। এই বিজ্ঞানীরা দেখলেন, তরল হিলিয়ামের সান্দ্রতার মান শূন্য। এর ফলে একবার চলতে শুরু করলে তরল হিলিয়াম টানা চলতে থাকে। আর কোনো পাত্রের মধ্যে রাখলেও বিনা পরিশ্রম এটি সেখান থেকে বের হয়ে প্রবাহিত হয়। অনেকটা কল্পবিজ্ঞানের সব সময়ে ধাবমান অক্ষয় প্রবাহের মতো। অতিপ্রবাহিতা যে পদার্থের একটা নতুন আর বিচিত্র দশা এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের দেখা পদার্থের এসব দশার একটি বিচ্ছিন্ন পরমাণু বা অণুর অবস্থা নয়, বরং শত লক্ষ কোটি অণুর সামষ্টিক গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ। ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। এ জন্য আমরা আমাদের চিরপরিচিত বরফ ও পানির মাঝের পরিবর্তনের কথা চিন্তা করতে পারি। যদি আমরা বরফের পানির একটি অণু আর (তরল) পানির একটি অণুর মাঝে তুলনা করি তাহলে তাদের মাঝে রাসায়নিক বা গঠনগত কোনো পার্থক্য দেখতে পাব না। তাহলে পানির এই দুই অবস্থার মাঝে পার্থক্য কোথায়? একটু চিন্তা করলেই আমরা দেখতে পাব—পানির অণুগুলো কীভাবে বিন্যস্ত আছে তার ওপরই মূলত নির্ভর করবে পানি কঠিন (মানে বরফ) অবস্থায় থাকবে নাকি তরল আকারে থাকবে। অতিপরিবাহিতার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমনি। সরলভাবে বললে, তড়িত্প্রবাহে অংশগ্রহণকারী ইলেকট্রনগুলোর প্রবাহ কীভাবে বিন্যস্ত তার ওপর নির্ভর করবে আমরা অতিপরিবাহিতা পাব কি পাব না। তবে আধুনিক সংজ্ঞানুসারে অতিপরিবাহিতা মানে রোধের মান শূন্য নয়।

পদার্থের চৌম্বক গুণাবলির দিকে ফিরে তাকাতে পারি। আমরা জানি কিছু কিছু পদার্থকে স্থায়ী চুম্বক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আবার কিছু কিছু পদার্থ এসব স্থায়ী চুম্বক দিয়ে আকর্ষিত হয়, কিন্তু নিজে স্থায়ী চুম্বক হয় না। প্রথম ধরনের পদার্থের চৌম্বক ধর্মকে আমরা ফেরোচৌম্বকত্ব বলি আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে (অস্থায়ী) চৌম্বক ধর্মটির নাম পরাচৌম্বকত্ব। কিন্তু যে চৌম্বক ধর্মটি পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্রানুসারে সব পদার্থেরই দেখানোর কথা, সেটা হচ্ছে চুম্বক ক্ষেত্র দিয়ে বিকর্ষিত হওয়া। এটাকে আমরা ডায়াচৌম্বকত্ব বলি। এই ঘটনার তীব্রতা অত্যন্ত সামান্য। তাই খুব শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্র না হলে এটার প্রভাব অনুভব করা যায় না। ২০০০ সালে রুশ বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী আন্দ্রে জিম একটি চৌম্বকক্ষেত্রের মাঝে শূন্যে একটি ব্যাঙ ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন (চিত্র)। আসলে তিনি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন ব্যাঙের শরীরে অনুভূত ডায়াচৌম্বকত্ব। ঘটনাটি বিজ্ঞানের জগতে প্রচুুর হাসির খোরাক জুগিয়েছিল। আর আন্দ্রে জিম এ জন্য ওই বছরের ইগ-নোবেল নামের ব্যঙ্গাত্মক পুরস্কারটি পান। তবে গ্রাফিন আবিষ্কার করে এই আন্দ্রে জিমই আবার ২০১০ সালে নোবেল পুরস্কার জেতেন। এ কারণে একই সঙ্গে নোবেল ও ইগ-নোবেল জয়ের বিরল সম্মানধারী এক বিজ্ঞানী হিসেবে আন্দ্রে জিম ভূষিত হয়েছেন। সব অতিপরিবাহী ডায়াচৌম্বকত্ব ধর্ম প্রদর্শন করে। এ জন্য বর্তমানে ডায়াচৌম্বকত্ব অতিপরিবাহিতার সংজ্ঞারই অবিচ্ছেদ্য একটা অঙ্গ—যেটা উপরে উল্লেখ করা ছিল।  

পদার্থের যেসব দশার কথা এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা উপরে উল্লেখ করেছি তার সবগুলোই অণু-পরমাণুর বিন্যাসের কারণে হয়। কিন্তু এখানে একটা ছোট শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। আমাদের চেনা পরমাণুর ভরের প্রায় শতভাগই জমা থাকে তার নিউক্লিয়াসে। তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দশা পরিবর্তন লুকিয়ে থাকার কথা নিউক্লিয়াসে। নিউক্লিয়াস নিজেও প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে তৈরি। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এখানেও কি এদের পরমাণুর মতো কোনো রকম পুনর্বিন্যাস ঘটতে পারে? এ প্রশ্নগুলো আমাদের প্রতিদিনের জীবনে কোনো ভূমিকা না রাখলেও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের যে গভীর প্রশ্নগুলো নিয়ে বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামাচ্ছেন তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা জানি যে নক্ষত্রের অন্তিম দশা কী হবে তা নির্ভর করে তার মাধ্যাকর্ষণজনিত সংকোচনকে থামাতে  কী ধরনের বল সক্ষম তার ওপর। যদি ইলেকট্রনের ফার্মি চাপ (যা মূলত পাউলির বর্জন নীতির কারণে উদ্ভূত হয়) এই সংকোচনকে থামাতে পারে, তবে আমরা নক্ষত্রের শেষ অবস্থায় শ্বেত বামন পাব। অন্যান্য ক্ষেত্রে একই যুক্তিতে আমরা নিউট্রন তারা ইত্যাদি পেতে পারি। এখন আমরা জানি, নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রন  উভয়ই মৌলিক কণাবিজ্ঞানের ভাষায় তৈরি (যার কথা বিজ্ঞানচিন্তার বিগত সংখ্যায় উল্লেখ করেছিলাম)। তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো, কোয়ার্ক ও গ্লুয়ন দিয়ে তৈরি পদার্থের মাঝে কত প্রকার দশা হতে পারে? আর একাধিক দশা থাকলে কী তাপমাত্রা বা চাপে এখানের এক দশা থেকে অন্য দশায় রূপান্তর ঘটবে? এ রকম অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা আজও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এর উত্তর তারা যেমন সুপারকম্পিউটারের জটিল হিসেবে কষছেন, তেমনি সার্ন বা নিউইয়র্কের ব্রুবহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে ভারী আয়ন নিয়ে করা পরীক্ষার ডেটার মাঝেও খুঁজছেন। এর উত্তর আমরা আগামী দশকের মাঝামাঝি পাওয়ার আশা রাখি। সোজা কথায় পদার্থের সব দশা আমরা দেখে যেতে চাই।

লেখক: অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধ্যাপক, ফিজিকেল সায়েন্সেস, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা