মহাবিশ্বের সব দিক একই রকম

ফার্দিন্যান্ড ম্যাগেলন ছিলেন পর্তুগিজ নাবিক। ৫০০ বছর আগে জাহাজে চড়ে সম্পূর্ণ পৃথিবীটা ঘুরে দেখেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, পৃথিবী গোল, পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বসবাস, উঁচু-নিচু বলে কিছু নেই। এই ধারণা সমাজেও মানুষকে উঁচু-নিচু ভাবার প্রবণতা থেকেও দূরে সরিয়েছিল। এ ধারণাকে প্রমাণের জন্য ১৫১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, ২৩৯ জনের বেশি নাবিক নিয়ে তিনি স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ম্যাগেলনের নেতৃত্বে এবং অবিচল সংকল্পের প্রেরণায় এই দুঃসাহসিক জলযাত্রা শুরু হয়। স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে আরম্ভ করে লোহিত সাগর হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের বাঁক ঘুরে আটলান্টিক হয়ে, প্রশান্ত সাগরের মধ্য দিয়ে আবার ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে মাগেল্লানের জাহাজ ফিরে এসেছিল। ফিরে এসেছিল মাত্র কয়েকজন নিয়ে।

পৃথিবী শুধু গোল হয়ে তার উঁচু-নিচু প্রভেদটাকে দূর করেনি; বরং নিজেকে বিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে ফেলেছে। এই বিকেন্দ্রীকরণের ইতিহাসটা শুরু হয়েছিল পোলিশ বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাসের কাজের মাধ্যমে ১৫৪৩ সালে। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী নয়, সূর্যই বিশ্বের কেন্দ্র আর পৃথিবী একটা গ্রহ, যা সূর্যকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার পথে ঘোরে। নিউটন তাঁর মহাকর্ষ তত্ত্বের মাধ্যমে ১৬৯৭ সালে দেখান, পার্থিব অভিকর্ষ ও মহাকর্ষকে যদি একটি সূত্রে সাজানো যায়, তাহলে তাদের অধীনে গ্রহগুলো ঘুরতে থাকে ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়মিতভাবে, নদীর জোয়ার-ভাটা ওঠে-নামে নিয়ন্ত্রিত ছন্দে, আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সংযুক্ত থাকে একই কারণে। নিউটনের এই তত্ত্ব আমাদের ব্যাখ্যা করে যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে সেকেন্ডে ১৮ মাইল বেগে ঘুরছে এবং কেন আমরা চলমান পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়ছি না। সবচেয়ে বড় কথা পৃথিবীর গোলকত্বের যৌক্তিক ভিত্তিও এই মহাকর্ষ তত্ত্বের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আমরা বিখ্যাত এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীর দেখা পাই। নাম ছিল উইলিয়াম হার্শেল। তিনি সংগীতজ্ঞও ছিলেন। দৃশ্যমান আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের অবস্থান ও দূরত্ব তালিকাভুক্ত করেছিলেন তিনি। এ থেকে যুক্তিসংগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিই হলো আমাদের বিশ্ব। মানুষের সান্ত্বনা ছিল যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে আবর্তনকারী একটি সাধারণ গ্রহ হলেও সূর্য এই গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত। কিন্তু ১৯১৫ সালের দিকে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে হারলো শেপলি বেশ সাহস করে প্রস্তাব করলেন, সৌরজগতের অবস্থান হলো গ্যালাক্সির প্রান্তে। আজ আমরা জানি যে ছায়াপথের (মিল্কিওয়ে) কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৭ হাজার আলোকবর্ষ দূর দিয়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে আবর্তন করে চলেছে আমাদের সূর্য। সেকেন্ডে প্রায় ১৫৬ মাইল গতিতে গ্যালাক্সিকে সম্পূর্ণ একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে ২৫ কোটি বছর। এও জানি যে এ গ্যালাক্সিতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি সূর্যের মতো নক্ষত্র আছে, যার মধ্যে অন্তত ১০ হাজার কোটিতে আমাদের সৌরজগতের মতো গ্রহমণ্ডল থাকা সম্ভব। সম্প্রতি সৌরজগতের বাইরে ৩ হাজার ৬০০ গ্রহের আবিষ্কার সে কথাকেই সমর্থন করছে। অনেক গ্রহে কার্বনভিত্তিক প্রাণ থাকার পূর্বশর্ত হিসেবে পানির থাকার সম্ভাবনাও মিলছে।

১৯২৪ সালে হাবলের আবিষ্কার থেকে জানা যায়, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মতো অসংখ্য গ্যালাক্সি মহাশূন্যে অপরিমেয় দূরত্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমাদের সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি অ্যান্ড্রোমিডাতে আলোর গতিতে ছুটে যেতেও সময় লাগবে ২০ লাখ আলোকবর্ষ। এদিকে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের মাধ্যমে মহাবিশ্বের চতুর্মাত্রিক গোলকের প্রস্তাব করেন, যার পৃষ্ঠটা ত্রিমাত্রিকঅনেকটা ত্রিমাত্রিক গোলকের দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠের মতো।

১৯২২ সালের দিকে রুশ গণিতবিদ ফ্রিডম্যান আইনস্টাইনীয় মডেলকে একটি প্রসারণশীল মহাবিশ্ব ও পরাবৃত্তিক স্থান বলে বর্ণনা করেন। প্রথমটি হলো, আমরা যেদিকে তাকাই না কেন, মহাবিশ্বের রূপ একই রকম দেখাবে। আর দ্বিতীয়টি হলো, আমরা যদি মহাবিশ্বকে অন্য জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণ করি তাহলেও মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাবে। শুধু এই দুটি ধারণা থেকে ফ্রিডম্যান দেখিয়েছিলেন, মহাবিশ্বকে স্থির অবস্থায় দেখা উচিত নয়। এসব ধারণা অনুযায়ী মহাবিশ্ব আমাদের কাছে এমন একটা জগতে পরিণত হয়, যার প্রতিটা বিন্দুই প্রান্ত ও প্রতিটা বিন্দু কেন্দ্র, অর্থাত্ প্রতিটা স্থানই সাধারণ।

কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক জন্মগতভাবেই ত্রিমাত্রিক জগতের ধারণা নিয়ে তৈরি হয়েছে। তাই আমাদের পক্ষে এমন গোলকের চিন্তা করা সম্ভব নয়, যার প্রতিটা বিন্দুই একেকটা কেন্দ্র। স্টিফেন হকিং ও জেমস হার্টলির নো বাউন্ডারি কন্ডিশন প্রকল্প দেখিয়েছে, আমাদের ত্রিমাত্রিক মহাবিশ্বটা স্থানের আরেকটি মাত্রায় বেঁকে গিয়ে একটি চারমাত্রিক মহাবিশ্ব তৈরি করেছে এবং একটি উচ্চ মাত্রার গোলকীয় ক্ষেত্রে আবদ্ধ হয়ে গেছে। তেমনি সময়ের মাত্রাটিও আরেকটি মাত্রায় বেঁকে গিয়ে মহাবিশ্বের ইতিহাসটাও একটি গোলকীয় মাত্রায় আবদ্ধ হয়ে গেছে। অর্থাত্ স্থানের একটি ও সময়ের একটি মাত্রা বেঁকে গিয়ে পুরো মহাবিশ্বটাই একটি গোলকীয় ক্ষেত্রে আবদ্ধ হয়ে গেছে। তাহলে মহাবিশ্বের বাইরে থেকে যদি আমাদের দেখা সম্ভব হতো, তাহলে দেখতাম সময়ের বাঁকে বাঁকে ঘটনার প্রবাহ বিন্যস্ত হয়ে আছে, যার বেশির ভাগই ক্ষমতা দখল ও আঁকড়ে থাকার ইতিহাস, অন্যের ওপর আদর্শ চাপিয়ে দেওয়া এবং অন্যকে বঞ্চিত করে সম্পদের পাহাড় গড়ার আর হত্যা-সংঘর্ষের ইতিহাস আর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের ইতিহাস।

১৯২৯ সালে বাস্তবিকই হাবলের আবিষ্কার থেকে বোঝা গেল সত্যিই গ্যালাক্সিগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে অর্থাত্ বিশ্ব প্রসারণমান। আর এই সরে যাওয়ার হার আমাদের কাছ থেকে দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে সমানুপাতিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। আর যেকোনো দিকে একই রকম দেখাচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবেই আমরা   আসলে বিকেন্দ্রিক। অথচ আমাদের সমাজজীবন তার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এককেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডই পরিচালনা করছে।

লেখক: বিজ্ঞানবক্তা