চোখ থাকিতেও অন্ধ

মৃত্যুর আট দিন আগে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর একটি গল্প লিখেছিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। ক্যানসারে আক্রান্ত ৮১ বছর বয়সী লেখক তখন হাসপাতালের রোগশয্যায়। গল্পটি তিনি মুখে বলেছেন। তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক সেটা শুনে শুনে লিখে নিয়েছেন।

গল্পের নাম জন্মান্ধ রমজান। পটভূমি সৈয়দ হকের সেই বিখ্যাত কাল্পনিক জনপদ জলেশ্বরী। সেই জনপদে রমজান নামের এক জন্মান্ধ গায়কের কাহিনি। জগত্টাকে দেখতে পাওয়ার তীব্র আকুতি ওই গায়কের মনে। গল্পের শেষে দেখা যায়, গ্রামে এক অলৌকিক মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে। সেই মহাপুরুষ জন্মান্ধের বুজে রাখা চোখে আঙুল (গল্পের ভাষায় দুটি তর্জনী) রাখলে রমজানের জগত্ ‘দুধসাদা আলোয় ভরে যায়।’ গল্পে বলা হচ্ছে:

‘সে (রমজান) চিত্কার করে ওঠে, এত আলো মুই সবার না পারি।’

লোকটি বলেন, ‘পারবে, পারবে। চোখ মেল। হে জন্মান্ধ, চোখ মেল।’

গল্পটি এখানেই শেষ হয়। বোঝা যায়, অলৌকিক এই মহাপুরুষের স্পর্শে রমজান দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে। তার চোখ ভালো হয়ে গেছে। গল্পটা প্রতীকী, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা যদি প্রতীকের ব্যাপারটা ভুলে থাকি, যদি আক্ষরিক অর্থে নিই রমজানের দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার কাহিনি, তাহলে একটা জটিলতা তৈরি হয়। জটিলতাটি হলো, মহাপুরুষের স্পর্শে চোখ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেলেও ওই মুহূর্তে চোখ মেলে রমজান জগত্ দেখতে পেত না। বলতে কি, সে কিছুই দেখতে পেত না। রমজান যদি জন্মান্ধ হয়ে থাকে, দেখার কোনো স্মৃতি যদি তার না থেকে থাকে এবং এ পরিস্থিতিতে তার চোখের জন্মগত ত্রুটি যদি হঠাত্ করে সেরে যায়, তাহলে চোখ মেলে সে কিছুই দেখতে পাবে না।

কেন পাবে না?

এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে দেখা ক্রিয়াটা কী, সেটা আমাদের আগে ভালো করে বুঝে দেখতে হবে। সবার আগে বুঝতে হবে, দেখা বা দর্শন নামের কর্মটি করার জন্য আমাদের আসলে একটি নয়, দুটি অঙ্গ দরকার হয়। একটি হলো চোখ, আরেকটি মগজ। চোখের রেটিনা নামক পর্দায় বাইরের জগতের যে ছবি গিয়ে পড়ে, সেটা অপটিক নার্ভে বাহিত হয়ে মগজের অন্তত পাঁচটি আলাদা এলাকায় (থ্যালামাস, পেরিয়েটাল করটেক্স, ইনফারোটেমপোরাল করটেক্স ইত্যাদি) ধারাবাহিকভাবে রিলে হয়, ঠিক যেমন করে টেলিভিশন বা বেতার সিগন্যাল এক টাওয়ার থেকে আরেক টাওয়ারে রিলে হয়।

মগজের একেকটি এলাকায় চলে দৃশ্যগত সংকেতের (সিগন্যাল) একেক ধরনের বিশ্লেষণ। এসব সংকেতের সঙ্গে মগজে আগে থেকে উপস্থিত নানান ধারণা ও স্মৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে একটা অর্থ দাঁড় করায় মগজ। কাজটা অনেকটা সিনেমা পরিচালকের এডিটিং টেবিলের মতো, যেখানে ধারণকৃত দৃশ্যের অনেক কিছু কেটে বাদ দেওয়া হয়, দৃশ্যের ক্রম বদলে ফেলা হয়, কিছু পুরোনো দৃশ্য বা স্টক ফুটেজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, শব্দ সংযোজন বা বিয়োজন করা হয়, সারফেস সাউন্ড সংযোজন করা হয় এবং সর্বোপরি সিনেমাটার একটা নাম দেওয়া হয়। পরিচালক এই কাজগুলো সম্পাদন না করলে যেমন সিনেমা তৈরি হয়েছে বলা যাবে না, তেমনটি দেখা ক্রিয়াটা মগজের ভেতরে বিভিন্ন ধাপ না পেরোনো পর্যন্ত মানুষ দেখতে পাচ্ছে বলা যাবে না।

মগজের ভেতরে দৃশ্যগত সংকেতগুলো নিয়ে যে কারবার চলে, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ সম্পাদনা হয় ইনফারোটেমপোরাল করটেক্স নামের এলাকায়। চোখ যে জিনিসটা দেখছে, এখানে সেটার অর্থ নির্ণয়ের কাজ চলে। যেমন ধরা যাক, আমরা যদি একটা চেয়ারের ছবি দেখি, সেই ছবির সংকেতগুলো মগজের এই অংশে এসে চেয়ার দেখার পুরোনো স্মৃতি এবং চেয়ারসংক্রান্ত ধারণার সঙ্গে মেলানো হবে। মিলে গেলে শুধু তখনই আমরা বুঝতে পারব যে আমরা যা দেখছি, সেটা একটা চেয়ার।

অর্থাত্ দেখা ক্রিয়াটার মোদ্দা কথা হলো, কী দেখছি সেটা বোঝা, অনুধাবন করা। তার মানে এটা একধরনের ইন্টারপ্রিটেশন বা অনুবাদকর্ম। যেকোনো অনুবাদকর্ম করতে হলে আগে থেকে জানা দুটি ভাষার ওপর দখল থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে দেখার স্মৃতি এবং মগজের কিছু পূর্ব ধারণা হচ্ছে সেই ভাষা। যদি দেখার স্মৃতি না থাকে? অর্থাত্ লোকটা যদি জন্মান্ধ হয়, যেমনটা হয়েছে সৈয়দ হকের গল্পের চরিত্র রমজানের ক্ষেত্রে?

দেখার স্মৃতি না থাকলে কী ঘটবে, তা নিয়ে একটা উত্কৃষ্ট কিংবদন্তি চালু আছে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের তিনটি জাহাজ যখন প্রথম আমেরিকা ভূখণ্ডের তীরে ভিড়ছিল, তখন সৈকতে দাঁড়িয়ে থাকা নেটিভ ইন্ডিয়ানরা নাকি সেদিকে তাকিয়ে থেকেও কিছুই দেখতে পায়নি। তার কারণ জাহাজ দেখার কোনো পূর্বস্মৃতি তাদের ছিল না।

কথাটা অতিরঞ্জন, সন্দেহ নেই। কিন্তু দেখা ক্রিয়াটার মর্মবাণী এর মধ্যে নিহিত।

হংকংয়ের একটি বিখ্যাত হরর সিনেমার কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। সিনেমার নাম দ্য আই। এটা পরে হলিউড ও বলিউডেও (ঊর্মিলা মাতণ্ডকরের ন্যায়না) রিমেক হয়েছে। ওই সিনেমায় দেখা যায়, অতি শৈশবে দৃষ্টিশক্তি হারানো এক তরুণী প্রায় ৩০ বছর পর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায় কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে। কিন্তু সে টের পায়, সে যা দেখছে, তার মধ্যে কোথাও একটা গভীর অসংগতি আছে। মেয়েটি এমন বিশেষ কিছু দেখতে পাচ্ছে, যেটা অন্যরা পাচ্ছে না। তখন সে এক সাইকোলজিস্টের দ্বারস্থ হয়।

সাইকোলজিস্ট তাকে বলেন, দেখার কাজটি তাকে ধীরে ধীরে শিখতে হবে। দেখার জগতের সঙ্গে তার ওরিয়েন্টেশন দরকার।

দেখা নামক ব্যাপারটা যে জটিল, চিকিত্সাবিজ্ঞান এটা টের পাওয়ারও অনেক আগে টের পেয়ে গিয়েছিলেন দার্শনিকেরা। উইলিয়াম মলিনেক্স নামের সপ্তদশ শতাব্দীর এক আইরিশ দার্শনিকের স্ত্রী ছিলেন জন্মান্ধ। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার কারণে কি না কে জানে, মলিনেক্স জন্মান্ধদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া নিয়ে একটা ধাঁধা বা থট এক্সপেরিমেন্ট তৈরি করেছিলেন। ধাঁধাটি ‘মলিনেক্স প্রবলেম’ নামে সুবিদিত। এক জন্মান্ধ ব্যক্তির কথাই ধরা যাক। তার জগিট স্পর্শ আর শব্দ দিয়ে তৈরি। স্পর্শ করে করে লোকটি জানে কোনটি গোলক আর কোনটি ঘনক। এখন লোকটি যদি কোনো দিন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়, সে কি শুধু তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারবে, কোনটি গোলক আর কোনটি ঘনক?

এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে দুনিয়ার দার্শনিকেরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। একদল বলেছেন, জ্যামিতিক আকারের ব্যাপারটা অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ একটা ছাঁচ। মানুষ সহজাত ইনটুইশনের জোরেই জানে কোনটা গোলক আর কোনটা ঘনক। আরেক দল সেটা মানতে নারাজ।

আমেরিকার এমআইটির ভিশন অ্যান্ড কম্পিউটেশনাল নিউরোসায়েন্স-বিষয়ক অধ্যাপক ড. পবন সিং ৪০০ বছরের পুরোনো এই বিতর্কের একটি জবাব লিখেছেন ২০১১ সালে। ড. সিং ২০০৩ সাল থেকে ‘প্রজেক্ট প্রকাশ’ নামের একটি অলাভজনক ক্লিনিক চালাচ্ছেন, যেখানে নানা ধরনের অন্ধদের অপারেশন করে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এসব অন্ধের একটি অংশ জন্মান্ধ। পবন সিং এই জন্মান্ধদের দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার মুহূর্তটি নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল মলিনেক্স ধাঁধার একটা চূড়ান্ত জবাব খোঁজা।

ড. পবন সিংয়ের সিদ্ধান্ত, জন্মান্ধ ব্যক্তি দৃষ্টি ফিরে পেলেও তাকিয়ে থেকে বলতে পারবে না কোনটি গোলক আর কোনটি ঘনক। তার স্পর্শের জগতের সঙ্গে সে এই দৃশ্যগত জগতকে মেলাতে পারবে না। সে আসলে কোনো কিছুরই কোনো অর্থ তৈরি করতে পারবে না। শুরুর বেশ কিছুদিন জগত্ তার কাছে এক তুমুল জগাখিচুরি বলে মনে হবে। যেমন ধরা যাক, সে একই মাপের দুটি টাইপরাইটার দেখছে। সে দেখবে কাছের টাইপরাইটারটি বড়, দূরেরটি ছোট দেখাচ্ছে। এটা তার কাছে বিরাট অসংগতি বলে মনে হবে। কেননা, অন্ধ অবস্থায় সে কাছের এবং দূরের দুটি টাইপরাইটারই স্পর্শ করে ‘দেখেছিল’—দুটিই সমান।

দৃষ্টিশক্তিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ স্টিফেন কসলিন বলেন, আমরা যে জগত্টাকে আমাদের চোখ দিয়ে দেখি, তার অনেক কিছুই আসলে আমাদের মগজের বানানো। আর দেখার অভিজ্ঞতা জড়ো করে করেই এই দেখার জগত্টা আমরা বানিয়েছি। যেমন আমরা আসলে দুই চোখ দিয়ে দুটি আলাদা ছবি দেখি। সেই দুটি ছবিকে একটার ওপর আরেকটা ফেলে আমরা একটা অভিন্ন ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) দৃশ্যের জগত্ বানিয়ে নিই। যে ব্যক্তি এই কাজটায় অভ্যস্ত হয়নি, সে শুরুতে দুটা আলাদা ছবি দেখবে এবং তখন তার কাছে দুনিয়াটা ঘোলা ঘোলা লাগবে, থ্রিডি চশমা ছাড়া থ্রিডি সিনেমা দেখার মতো। তার মানে হলো, আমরা আসলে একটা থ্রিডি চশমা সব সময় পরে আছি। প্রকৃতিই সেই চশমা বানিয়ে দিয়েছে। আর সেটা বসানো আছে আমাদের মগজের ভেতরে, থ্যালামাস অঞ্চলে।

ভিন্ন একটা প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করি। আঠারো শতকের শুরুর দিক থেকে মানুষ চোখের ছানি অপারেশন করা শিখেছে। তারপর থেকে কত যে নিরাময়যোগ্য জন্মান্ধ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে, তার হিসাব নেই। চিকিত্সাবিজ্ঞান সেই কাজটিই এত দিন করে এসেছে, কবিগুরু যেটা করতে বলেছেন (অন্ধজনে দেহ আলো)। এখন একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে মানুষ এমন একটি বাড়তি কাজ করতে শুরু করেছে, যেটা কবিগুরু বলেননি বা বলে যাওয়ার সুযোগ পাননি। মানুষ দৃষ্টিদান করতে শুরু করেছে এমন অনেক কিছুকে, যেগুলো অন্ধজন তো নয়ই, এমনকি যেগুলো কোনো প্রাণীই নয়। তারা যন্ত্র। 

কয়েক বছর ধরে গুগলের কিছু চালকবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল করছে। রাস্তায় নামানোর আগে এই গাড়িগুলোকে সবচেয়ে জরুরি যে গুণে গুণান্বিত করতে হয়েছে, সেটি হলো দৃষ্টিশক্তি। গুগলের গাড়িগুলো ‘দেখতে পায়’। তারা সামনের রাস্তা এবং সেই রাস্তায় চলাচলকারী অন্য গাড়ি এবং পথচারীদের ‘দেখতে পায়’। এই বিশেষ গুণটি পাওয়ার জন্য গুগলের গাড়িগুলোর ছাদে একটা যন্ত্র বসাতে হয়েছে, যেটার নাম লিডার। লিডার বিভিন্ন ধরনের ছবি, স্যাটেলাইট ইমেজ ও অন্যান্য ডেটা সংগ্রহ করে গাড়ির চারপাশের এলাকার একটা ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করে। ছবি তৈরি করে কী করে? ছবি তৈরি করে ‘বুঝে দেখে’ যা দেখছে সেটার অর্থ কী। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নয়। এই যদি ব্যাপার হয়, তাহলে গুগলের গাড়িগুলো ‘দেখতে পাচ্ছে’ বলতে অসুবিধা কোথায়?

লেখক: সাংবাদিক