জ্যোতিষশাস্ত্র বনাম জ্যোতির্বিজ্ঞান

জ্যোতিষশাস্ত্র আর জ্যোতির্বিজ্ঞান এক নয়। একটি বিজ্ঞান, অন্যটি অপবিজ্ঞান। ধূর্ততায় আমরা হয়তো মুগ্ধ হই ভুল ভেবে। বছরের শেষে বা আসন্ন নতুন বছরের শুরুতে অনেকেই হয়তো নিজের রাশিফলে একবার আলতো করে চোখ বুলিয়ে নিই। ভাবি, বছরটা কেমন কাটবে? বছরের রাশিফল দেখতে গিয়ে হয়তো চোখ আটকায় সেসব জিনিসেই, যেগুলো আপনার জন্য আসন্ন বছরে গুরুত্ববহ। এসব কি সত্যিই কাজ করে?

বছরের শেষে বা আসন্ন নতুন বছরের শুরুতে অনেকেই হয়তো নিজের রাশিফলে একবার আলতো করে চোখ বুলিয়ে নেন। ভাবেন, বছরটা কেমন কাটবে? বছরের রাশিফল দেখতে গিয়ে হয়তো চোখ আটকায় সেসব জিনিসেই, যেগুলো আপনার জন্য আসন্ন বছরে গুরুত্ববহ। যেমন ধরুন, আপনি যদি এ বছর পড়াশোনা শেষ করেন, তবে খুঁজছেন চাকরিপ্রাপ্তির সম্ভাব্যতা। যদি বড় কোনো পরীক্ষা থাকে, তবে সেটার ভবিষ্যদ্বাণীতে ঝুঁকছেন। যা-ই দেখুন না কেন, এসব কি সত্যিই কাজ করে?

আকাশকে আমরা দেখি একটা থালার মতো। যেন থালার মাঝে হাজার হাজার তারা এঁকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসল আকাশ দ্বিমাত্রিক নয়, ত্রিমাত্রিক। কোনো তারা অনেক দূরে, কোনোটা অল্প দূরে। এই অল্পটাও কিন্তু শত কিংবা হাজার আলোকবর্ষ। আকাশের এই থালাকে ভাগ করা হয়েছে ৮৮টা অঞ্চলে। এগুলোকে বলা হয় মণ্ডল।

আগে মণ্ডল ধরা হতো কয়েকটি উজ্জ্বল তারাকে ধরে একটা আকৃতি কল্পনা করে। এ ক্ষেত্রে প্রাচীন গ্রিক, চীনা, আরবি, ভারতীয় জ্যোতির্বিদেরা প্রায় একই রকম চিত্রের কল্পনা করছেন, কিন্তু একেকটি মণ্ডলের সীমারেখায় খানিকটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। তাই ১৯২৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির উদ্যোগে মণ্ডলের সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়।

পাশ্চাত্য জ্যোতিষশাস্ত্রে জন্মরাশি

পৃথিবী ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে, এটা সবারই জানা। কিন্তু সেটা আমরা দেখতে পাই না। দেখে আমাদের মনে হয়, সূর্যই বুঝি ঘুরছে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে। তাই এ উপবৃত্তকে অনেক সময় বলা হয় সূর্যপথ। পৃথিবীর সূর্যকে কেন্দ্র করে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে এক বছর। সূর্য বছরের একেক সময় একেক মণ্ডলে থাকে। বছরজুড়ে একবার পৃথিবী সূর্য ঘুরে আসতে আসতে মোট ১২টি মণ্ডলে থাকে। ৮৮টি মণ্ডলের মধ্যে রাশি হিসাবে ধরা হয় ১২টিকে। সেগুলো হলো মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন।

ভরদুপুরে যদি আপনি সূর্যের দিকে তাকান, তবে সূর্যের ওপারে আপনি কোনো তারা দেখতে পাবেন না। তার মানে এই নয়, ওপারে কোনো তারা নেই। আছে, সেগুলো আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। সূর্যের পেছনে যদি তারাগুলোকে দেখা যেত, তাহলে নিশ্চয়ই সূর্যকে একটি মণ্ডলীতে দেখা যেত। সেটি কোন মণ্ডলী? উত্তর হলো বারোটি রাশির যেকোনো একটি। কারণ, পৃথিবী ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে।

নভেম্বর মাসের কথাই ধরুন। সূর্য নামের তারার যে পাশে পৃথিবী অবস্থান করে, সেদিকটায় অবস্থান বৃষমণ্ডলীর। এখন পৃথিবী থেকে আপনি যদি সূর্যের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাওয়ার কথা তুলামণ্ডলীকে। তাই সূর্য তুলামণ্ডলীতে আছে বলে আপনার মনে হতো। এখন একজনের জন্মের সময় সূর্য যে রাশিটিতে থাকবে, তার রাশি হবে সেটিই।

ধরুন, কারও জন্মের সময় সূর্য ছিল সিংহমণ্ডলীতে, সে হবে সিংহ রাশির জাতক। সে হিসাবে জ্যোতিষীরা তার ভাগ্য গণনা করবেন, তার স্বভাবও নির্ণয় হবে সে অনুযায়ীই। সূর্য এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে যেতে সময় নেয় প্রায় এক মাস। তাই এই এক মাসের মধ্যে জন্ম নেওয়া সবাইকেই ধরা হয়ে থাকে এক রাশি।

রাশির সঙ্গে আছে জন্মলগ্ন

জ্যোতিষশাস্ত্রের একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, শুধু জন্মরাশি থেকেই একটা মানুষের গুণাগুণ নির্ণয় করা হয় না। জন্মলগ্নের হিসাবটাও করা হয়ে থাকে। জন্মলগ্নও ওই ১২ রাশির নামেই হয়। তবে হিসাবটা একটু ভিন্ন।

সে হিসাব বোঝার আগে একটা জিনিস জানা দরকার, সূর্যের মতো অন্য সব তারাও কিন্তু পূর্ব দিকে উদয় হয়। অস্ত যায় পশ্চিম দিকে। এখন কারও জন্মের মুহূর্তে পূর্ব আকাশে যে রাশি উদয় হচ্ছে, সে রাশিই হবে তার জন্মলগ্ন। কারও যদি জন্ম হয় সূর্যোদয়ের সময়, তবে হিসাবটা সোজা। সূর্য তখন যে মণ্ডলীতে আছে, সেটি তার রাশি। আর সূর্যের সঙ্গে যেহেতু সে মণ্ডলটাও উদয় হচ্ছে, তাই তার জন্মলগ্নও হবে একই। যদি সূর্য একটুখানি মাথার ওপর উঠে যাওয়ার পর কারও জন্ম হয়? তবে তখন নিশ্চয়ই অন্য একটি মণ্ডল পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছে। তখন সেটিই হিসাব করা হবে তার জন্মলগ্ন হিসেবে। আর রাতের বেলা কারও জন্ম হলে সেটা হিসাব করা আরও অনেক সোজা। জন্মের মুহূর্তে পূর্ব দিগন্তে যে রাশিটিকে উদয় হতে দেখা যায়, সেটিই তার জন্মলগ্ন।

মোট রাশির সংখ্যা ১২টি। প্রতিটি রাশি যেহেতু ক্ষেত্রফলে বেশ বড়, অনেক তারা নিয়ে গঠিত, তাই একটা রাশি উদয় হতে মোটামুটি ঘণ্টা দুয়েক সময় নেয়। এই দুই ঘণ্টার মধ্যে যারা জন্ম নেয় জ্যোতিষশাস্ত্রে সবার জন্মলগ্ন ধরা হয় একই।

চাঁদের হিসাবে রাশি

ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রে রাশির হিসাব করা হয় চাঁদের হিসাবে। চাঁদের হিসাবে রাশি বের করার উপায়টাও সূর্য দিয়ে হিসাব করার মতোই। কারও জন্মের মুহূর্তে চাঁদ যে রাশিতে অবস্থান করে, তাকে সেই রাশির জাতক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। চাঁদ এক রাশি থেকে আরেক রাশিতে যেতে সময় নেয় আড়াই দিন। তাই পাশ্চাত্য হিসেবে যেখানে এক মাসের ব্যবধানে জন্ম নেওয়া সবাই এক রাশির হয়, এই হিসাবে প্রতি আড়াই দিনে জন্ম নেওয়া সবাই এক রাশির হবে। এখন চাঁদ কোন রাশিতে আছে চাঁদ আকাশে থাকলে সহজেই দেখে নেওয়া যায়। কিন্তু বছরজুড়ে একই সময় তো একই জায়গায় থাকে না। চাঁদ কখন কোথায় আছে, সেটা অবশ্য পঞ্জিকায় লেখা থাকে। পঞ্জিকা দেখে বের করা যায় কোন মুহূর্তে চাঁদের রাশি। আর এখন নানা সফটওয়্যার দিয়েও বের করা যায় চাঁদের অবস্থান।

জ্যোতিষশাস্ত্র আর জ্যোতির্বিদ্যা

ভাগ্যরাশি হিসাব করা হয় চাঁদ, সূর্য ও তারাদের দিয়ে। আসলে একসময় চাঁদ-তারাও যে পৃথিবীর মতো বস্তু দিয়ে তৈরি, মানুষ তা ভাবতে পারেনি। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান আসার আগে এদের নিয়ে গল্পগাথা বানানোটা তাই স্বাভাবিক ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় প্রথম তারাদের অবস্থান ও গতির সঙ্গে ভাগ্যকে যুক্ত করে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা শুরু হয়। প্রাচীনকালে দুটোই একসঙ্গে চর্চা হতো। সত্যি বলতে আধুনিক বিজ্ঞানের আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানের যতটা গবেষণা হয়েছে, তার প্রায় পুরোটাই ভাগ্য জানার উদ্দেশ্যে। মানুষের পথ চলতে তারার কিছুটা প্রয়োজন হতো বটে। সেটার গুরুত্ব বেশি ছিল না। জোহানেস কেপলারসহ আগের অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানীই ছিলেন একই সঙ্গে জ্যোতিষী। কারণ একটাই, জ্যোতিষশাস্ত্রকে ঘিরেই বেড়ে উঠেছে জ্যোতির্বিজ্ঞান। জ্যোতিষীরা যেহেতু ভাগ্য বলতে পারেন, তাই তাঁদের দাম ছিল সমাজে। চর্চা হতো সে কারণেও।

বিজ্ঞানে প্রমাণিত, একজন মানুষের স্বভাব হবে তার জেনেটিক গুণাবলি আর বেড়ে ওঠা পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে। সেখানে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের কোনো বাহাদুরি নেই। যদি তা-ই হতো তাহলে পৃথিবীর তাবত মানুষের ভাগ্য ও চরিত্র মাত্র ১২টা ভাগে ফেলা যায়। মানুষের মধ্যে এত বৈচিত্র্য কেন?

আকাশের যে রাশির অবস্থান দেখে জ্যোতিষীরা রাশির হিসাব করেন তা কিন্তু প্রায় দুই হাজার বছর আগের। এই দুই হাজার বছরে তারারা ঠিক আগের জায়গায় আর নেই। তাই রাশির অবস্থানও পাল্টে গেছে। জ্যোতিষশাস্ত্রের ভিত্তি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরা সূর্য-চাঁদ-তারা। সূর্য যে আমাদের ঘিরে ঘোরে না, সে খবরও তাঁদের কাছে নেই। চাঁদকেও গ্রহ ধরে হিসাব করেন জ্যোতিষীরা। ইউরেনাস আর নেপচুনের কথাও জানেন না তাঁরা। কারণ, সেই প্রাচীনকালে এ গ্রহ দুটো আবিষ্কার হয়নি!

তারপরও জ্যোতিষীদের কোনো কোনো কথা কখনো কখনো মিলে যায়। ব্যাপারটা হাস্যকর রকমের কাকতালীয়। ধরা যাক, কোনো একজন জ্যোতিষীর এক বছরের প্রতিদিনের রাশিফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, একটি নির্দিষ্ট রাশির জন্য তিনি মোটামুটি ৪০-৫০ বার প্রেমে সফলতার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। পুরোনো প্রেম ফিরে আসার কথা বলেছেন আরও অনেকবার। সেই এত দিনের কোনো একদিন যদি প্রেম চলে আসে, তবে বাহবা দিয়ে আমরা সেই জ্যোতিষীর অন্তর্দৃষ্টির প্রশংসা করি। একজনের জীবদ্দশায় হয়তো পাঁচ-দশ হাজারবার চাকরিপ্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা লিখবেন কোনো জ্যোতিষী। কিন্তু জীবনে হয়তো মিলবে পাঁচটি চাকরি। তবু ওই পাঁচ দিনে বাহবা দিয়ে জ্যোতিষীর পায়ের ধুলো নেবে চাকরিপ্রাপ্ত লোকটা। আসলে জ্যোতিষীরা আমাদের মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাহবা নেন, নেন অনেক টাকাপয়সাও।

সাধারণ বিবেচনাবোধই বলে দিতে পারে, একটা গ্রহ কিংবা তারা দূর আকাশে কোথায় আছে, সেটা এই মর্ত্যের লাখো-কোটি জীবনের ভাগ্য নির্ধারণ করে না। তবু জ্যোতিষীদের ধূর্ততা আমাদের মুগ্ধ বিশ্বাসে ডুবিয়ে রাখছে হাজার চারেক বছর ধরে। বিজ্ঞান কবে এই কুসংস্কারকে পুরোপুরি মুছে দিতে পারবে, কে জানে! জ্যোতিষশাস্ত্রে কোনো বিজ্ঞান নেই, যেটা আছে জ্যোতির্বিজ্ঞানে।

লেখক: শিক্ষার্থী, খাদ্য ও পুষ্টি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়