ফুড ক্যাম

মুফত খাবার আর গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের নিয়ে কৌতুকের কোনো কমতি নেই। পিএইচডি ছাত্রছাত্রীদের বেতন ভার্সিটির জ্যানিটরের চেয়েও কম বলে খাবার কিনে পয়সা খরচ করার মতো মানসিকতা তাঁদের একটু কম। সেই সূত্র ধরে পিএইচডি কমিকে বাস্তবধর্মী রসিকতার কোনো অন্ত নেই। অবশ্য যতটুকু নির্মম শোনাচ্ছে, ব্যাপারটা তত নির্মম নয়। এমনিতেই ভার্সিটির ডিপার্টমেন্টে সব সময় বিভিন্ন আয়োজন উপলক্ষে হরদম অনেক রকম খাবারের অর্ডার দেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ সময়েই খাবারের বড় একটা অংশ অবশিষ্ট হিসেবে বেঁচে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে সেটা বিতরণ করা হয় গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

এখন কথা হচ্ছে, বেঁচে যাওয়া খাবারের খবর শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাবে কী করে? সমাধানটা সহজ—শিক্ষার্থীদের ই-মেইল লিস্টে একটা ই-মেইল করে দেওয়া, খাবারের স্থান (রুম নম্বর) উল্লেখ করে। কিন্তু তাতেও সমস্যা থেকেই যায়। যেমন অনেক সময় খাবারের ই-মেইল পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখা যায়, খাবার সব শেষ। শুধু তা-ই নয়, অবশিষ্ট খাবারটা কী ধরনের আর খাবারের কতটুকুই বা বাকি আছে, জানতে পারলে দৌড়ে যাব না হেঁটে যাব, নির্ধারণ করতে সুবিধা হয়। আমি নিজে ছাত্র থাকাকালে অনেকবার খাবারের ই-মেইল পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখেছি, বাকি আছে কয়েকটা সালাদের পাতা মাত্র। আবার অনেক সময় আলসেমি করে ই-মেইল উপেক্ষা করে দেখেছি, সেই দিন অবশিষ্ট খাবারের মধ্যে ছিল স্যামন মাছের বড় বড় টুকরা। ব্যাপারটা আমাকেসহ ডিপার্টমেন্টের আরও অনেককেই ভোগাচ্ছিল। তাই সমাধানে এগিয়ে এলেন এমআইটি মিডিয়া ল্যাবের কিছু সৃজনশীল গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী।

সমাধান: ফুড ক্যাম! কিন্তু ব্যাপারটা কী? ফুড ক্যাম হচ্ছে একটা ডিপার্টমেন্টের একটি নির্দিষ্ট জায়গা, যেখানে সবাই অবশিষ্ট খাবার রেখে আসবে। রুমটার ওপরে সিলিংয়ে লাগানো হলো একটা অত্যাধুনিক ক্যামেরা ও ক্যামেরার পাশে লাগানো হলো একটা বেল। যে কেউ এখানে খাবার রেখে বেলে চাপ দিলে সঙ্গে সঙ্গে পুরো ডিপার্টমেন্টের সবার কাছে খাবারের ছবিসহ ই-মেইল পৌঁছে যাবে। শুধু তা-ই নয়, যেকোনো সময় http://foodcam.media.mit.edu/view/view.shtml ঠিকানায় গেলে দেখা যাবে, এ মুহূর্তে কতখানি খাবার বাকি আছে।

ফুড ক্যামের সূচনা শুধু খাবারের সংবাদ পৌঁছে দিতে শুরু হলেও অনেক মজার গবেষণামূলক কাজও এর মাধ্যমে শুরু হয়েছে। যেমন, একজন শিক্ষার্থী একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছে, যা খাবারের ছবি দেখে ইমেজ প্রসেসিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খাবারের পুষ্টিগুণ নির্ধারণ করবে। পুষ্টিগুণের এ তথ্য খাবারের ছবিসহ ই-মেইলে জুড়ে দেওয়া হবে। এটা সম্ভব খাবারের রং, খাবারের আকার, বিস্তৃতি পর্যালোচনা করে। যেমন ধরুন, মজার মজার পিত্জার ছবির পাশাপাশি ওই খাবারে কতটুকু ক্যালরি থাকতে পারে, ওইটা জুড়ে দেওয়া যাচ্ছে।

আরেকজন চিন্তা করেছেন খাবারের ছবি দেখে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে বের করা খাবারটি কোন দেশি—মেক্সিকান চালুপা, ভারতীয় তৈলাক্ত তরকারি, পিত্জা, নাকি অন্য কিছু। এটা সম্ভব হয়েছে কয়েক বছরে ফুড ক্যামে জমা হওয়া ছবিগুলোকে মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে। আরও একদল শিক্ষার্থী তো ব্যাপারটাকে আরেক দফা সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। গত কয়েক বছরের খাবারের ঘোষণার সময় পর্যালোচনা করে বের করার চেষ্টা করেছেন, সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে কোন দিনে কোন ঘণ্টায় কোন ধরনের খাবারের সন্ধান মিলতে পারে। যেমন সোমবার বেলা এক-দুইটার সময় ইন্ডিয়ান খাবার মেলার সম্ভাবনা ৭০%। তেমনি বৃহস্পতিবার বিকেলে চিজ পিত্জার দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০% বেশি। সময় ও খাবারের সম্ভাবনা আগে জানা থাকলে আগে থেকে ফুড ক্যামের পাশে সময়মতো ওত পেতে বসে থাকা যায়।

ফুড ক্যামের গুণে আমার মতো এমআইটি মিডিয়া ল্যাবের সব শিক্ষার্থীর খুব কমই নিজের টাকা দিয়ে খাবার কিনে খেতে হয়। ফ্রিতে পেটে ভালো খাবার পড়লে মেজাজটাও থাকে ফুরফুরে, তাই কাজেও মন বসে সহজে। মিডিয়া ল্যাবের যে কাউকে যদি আপনি জিগ্যেস করেন, ‘আচ্ছা, তোমরা এত সৃজনশীল কাজ করো, এটার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পাও?’ সবাই বিনা সংকোচে সমস্বরে বলবে, কেন? ফুড ক্যাম।

এটি লেখা হয়েছিল ২০১২ সালে

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র