বৈরুত বিস্ফোরণের রসায়ন

৪ আগস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এই দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১০০ লোক মারা গেছে। গৃহহীন হয়ে পড়েন প্রায় তিন লাখের বেশি মানুষ। গবেষকরা মনে করছেন এর পেছনে দায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নামের এক সাধারণ রাসায়নিক সার।

অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট যে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, তা কমবেশি অনেকেই জানেন। কিন্তু বন্দরে কেন এর বিস্ফোরণ হবে? লেবানিজ কর্মকতাদের মতে, বন্দরের একটি হ্যাঙ্গারে প্রায় ২ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মজুদ দীর্ঘদিন বন্দরে পড়ে ছিল ২০১৩ সাল থেকে।

বিস্ফোরণের আগে একটি আগুন জ্বলতে শুরু করেছিল। ছোট ছোট বিস্ফোরণ ও সাদা ধোয়ার মেঘ তৈরি করে। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মজুদটি যখন বিস্ফেরিত হয়, একটি ঘনীভূত সাদা ধোয়ার মেঘ স্থল থেকে বেরিয়ে আসে। লাল-কমলা রংয়ের ধোয়ার বিশাল শিখা হ্যাঙ্গার থেকে বেরিয়ে আসে। অনেক রসায়নবিদ মনে করছেন এই ধোঁয়ার কারণ নাইট্রজেন ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতি। অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইটের অসম্পূর্ণ বিক্রিয়ার কারণে উৎপন্ন হয়েছিল, বলে তাঁদের ধারণা। ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার দেখা গেছে বিস্ফোরণটির ছড়িয়ে পড়ার বেগ সেকেন্ডে প্রায় ৩০০ মিটার। এমন বেগ সাধারণত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বিস্ফোরণেই হয়।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ অ্যানড্রিয়া সেলারও একই মত। তিনি সিএনএনকে বলেছেন, ‌'সাধারণ পরিবেশে এই যৌগটি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তবে, আগুনের উপস্থিতিতে এটা বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।'

অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট হলো গন্ধহীন স্ফটিক এবং অত্যান্ত দাহ্য বস্তু। যখন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট আগুন জ্বালানোর মতো তাপ প্রয়োগ করা হয়, তখন এর অণুগুলো আর স্থিতিশীল থাকতে পারে না। কারণ, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটে নাইট্রোজেন দুটি আলাদা জায়গায় জারণ অবস্থায় থাকে। তাই এই দুইটি নাইট্রোজেন পরমাণুর মধ্যে একটিতে তাপ উৎপাদী বিক্রিয়া ঘটে। নাইট্রোজেন তখন জারক হিসেবে কাজ করে, যেখানে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিজারক পদার্থ হিসেবে কাজ করে।

যদি বিক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যায়, তাহলে শুধুমাত্র নাইট্রোজেন, পানি ও কিছুটা অক্সিজেন থাকে। কিন্তু উপজাত নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড সাধারণ অবস্থায় থাকে। কিন্তু গ্যাসীয় হওয়ায় হঠাৎ তাপ বৃদ্ধির শব্দের চেয়ে বেশি গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এবং বিস্ফোরণ ঘটায়।

বিস্ফোরণটা নিউক্লিয়ার বোমার মতো একটা মাশরুম ক্লাউড তৈরি হয়। মূল বিস্ফোরণের ২-৩ সেকেন্ড পরে দেখা যায় একটা ঘনীভূত মেঘ নিমিশের জন্য তৈরি হয় আবার হারিয়ে যেতে। এটা দেখে মনে হতে পারে, সমুদ্র থেকে বিপুল পরিমাণ পানি উঠে এসে বাতাসে উবে যাচ্ছে। বিস্ফোরণের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেছেন, এটা হয়ত নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ। কিন্তু সেলা জানিয়েছেন, এই ধরনের ঘনীভূত মেঘ আর্দ্র বাতাসে বিস্ফোরণ তৈরি করতে পারে।

ঘনীভূত মেঘ কীভাবে সৃষ্টি হলো তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সেলা বলেন, শক ওয়েভের পেছনে একটি নিম্নচাপের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। এটা জলীয় বাষ্পকে ঘনীভূত করে তোলে। শক ওয়েভের দুই পাশে চাপের পার্থক্যের কারনেও একটি আলোকপ্রভা তৈরি হতে পারে। কারণ, আলো দুইটি ভিন্ন ঘনত্বের বাতাসের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বেঁকে যেতে পারে।

অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরণে এর আগেও অনেক দেশে শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এ কারণেই বেশিরভাগ দেশ রাসায়নিক দ্রব্যের সঠিক সঞ্চয়ের বিষয়ে কঠোর নিয়মকানুন মেনে চলা হয়। বিশাল আয়তনের গুদামগুলোয় পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু বন্দরে সেই ব্যবস্থা ছিল না বলেই এই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

সূত্র: কেমিক্যাল এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ, আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি

লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি