একটি লুকানো ইতিহাসের খোঁজে

চাঁদে মানুষ নামার ঘটনাটা মানব ইতিহাসে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। প্রথমবারের মতো মানুষ পা রাখল পৃথিবীর বাইরের মাটিতে। এত বড় অর্জনের পেছনে নানা অজানা গল্প তো লুকিয়ে আছেই। কিন্তু বর্ণবাদ? হ্যাঁ, বর্ণবাদের গল্পও আছে লুকিয়ে। এমন অজানা এক গল্প নিয়েই বানানো হয়েছে এক চলচ্চিত্র, নাম হিডেন ফিগারস। বর্ণবাদ নিয়ে চলচ্চিত্র কম নয়। বেশির ভাগই মানুষকে দাবিয়ে রাখার গল্প, কিছু আছে বীরত্বের গল্পও। কিন্তু অর্জনের কথা লুকিয়ে রাখার গল্প নিয়ে বলার মতো চলচ্চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না সহজে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে রুশ-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধ চলে দীর্ঘ সময়। তাতে পৃথিবীব্যাপী নানা কিছুর সঙ্গে ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের লড়াইও। সে লড়াই মানবজাতিকে যে অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা মহাকাশ নিয়ে। তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে প্রথম মানুষ পাঠায়। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল কিছু একটা করে দেখানোর। বিজ্ঞানের যে সূত্রগুলো কাজে লাগবে তা তো মানুষ জানে বহু আগে থেকে, একেবারে নিউটনের সময় থেকে। কিন্তু তা হিসাব করে একদম ঠিক ঠিক মানগুলো বের করা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। যেমন চাঁদে মানুষ পৌঁছাতে হলে ঠিক কতটুকু জ্বালানি লাগবে, ঠিক কত বেগে কোন দিকে রকেট যাবে, আর তিন লাখ কিলোমিটার দূরের চাঁদে নেমে আবার কীভাবেই বা ফিরে আসবে এমন হিসাবগুলো করতে হয়েছে।

এখনকার দিনে সেগুলো করা খুব কঠিন নয়। কিন্তু সেই পঞ্চাশের দশকে? তখন কম্পিউটার হিসাব কষত পাঞ্চ কার্ড দিয়ে প্রোগ্রামিং দিয়ে। সেই কম্পিউটার ছিল আকারে বিশাল, গতি খুব কম। কোনো ইলেকট্রনিকস কম্পিউটার বাজারে আসেনি। সবচেয়ে দ্রুতগতির কম্পিউটারের গতিও ছিল আপনার বাসার মাইক্রোওয়েভ ওভেনের মধ্যে যে ছোট্ট কম্পিউটারটা আছে তার চেয়েও কম। এমন যুগে হিসাবগুলো করবে কে? কম্পিউটার যেহেতু নেই, মানুষ কম্পিউটার ব্যবহার ছাড়া উপায় কী? নাসাও ঠিক তা-ই করেছিল। কিন্তু কারা সে মানব কম্পিউটার জানেন? তিন কৃষ্ণাঙ্গ নারী। একজন কৃষ্ণাঙ্গ আট বছর ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাই বর্ণবাদের ব্যাপারটা বোঝা কঠিন এখন। কিন্তু সে এমন এক সময়, যখন কৃষ্ণাঙ্গদের একই কাতারের মানুষ ভাবতেও নারাজ ছিল  যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শ্বেতাঙ্গ।

সেই তিনজন গণিতবিদের কথা অজানাই রয়ে গেছে মানুষের কাছে। তাঁরা মেধা দিয়ে অসাধ্য সাধন করেছিলেন। হিসাব করেছিলেন রকেটের পথ, জ্বালানিএমন নানা কিছু। কিন্তু সে সময় তাঁরা শিকার হয়েছেন নানা বর্ণবৈষম্যের। ক্যাথরিন জনসন, ডরথি ভাউগান, ম্যারি জ্যাকসনভার্জিনিয়ার হ্যাম্পটনে ষাটের দশকে এই তিন নারী কাজ করতেন নাসার ল্যাংলি রিসার্চ সেন্টারে। তাঁরা কাজ করতে গিয়েছিলেন নিজেদের জীবন বদলের স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু বদলে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসই। তাঁদের হিসাবেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মানুষ হিসেবে জন গ্লেন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন। এখানেই মোড় নেয় মার্কিন মহাকাশ জয়ের ইতিহাস। ইউরি গ্যাগারিনকে রাশিয়া মহাকাশে পাঠানোর পর হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় এই ঘটনায়। এর জোরেই শেষ পর্যন্ত পরে জয় করে চাঁদ।

এই তিন আফ্রিকান-আমেরিকান নারী শুধু যে অঙ্ক কষেছেন তা-ই নয়, তাঁরা লড়াই করেছেন আশপাশের বৈষম্যের বিরুদ্ধেও। তাঁদের এই অবদানের কথা তুলে আনেন মার্গাট লি শেটারলি, তাঁর ননফিকশন বইয়ে। বইটি বেরোয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। বের হওয়ার পরেই উঠে আসে নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেস্টসেলার লিস্টে। বইটি থেকে একটা কমেডি চলচ্চিত্র বানিয়েছেন পরিচালক থিওডর মেলফি। মুক্তির আগেই প্রবল আলোচনা তুলেছে চলচ্চিত্রের জগতে। একই সঙ্গে আগ্রহ দেখাচ্ছেন বিজ্ঞান প্রযুক্তির মানুষও। সাংবাদিক আর সমাজবিজ্ঞানীদেরও আলোচনায় আছে চলচ্চিত্রটি। অজানা এই ইতিহাস জানতে দেখতে পারেন চলচ্চিত্রটি। একসঙ্গে মানুষের অধিকারের লড়াই, স্নায়যুদ্ধের জ্ঞান-বিজ্ঞানের লড়াই, আর মানুষের মহাকাশ জয়ের গল্প নানা কিছুর সমন্বয় আছে চলচ্চিত্রটিতে। আছে বিজ্ঞানের আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে অবদান রাখা না জানা মানুষদের স্বীকৃতির সুরও।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়