জিন ব্যাংক

জিন ব্যাংকও আসলে একধরনের ব্যাংক। তবে প্রচলিত ব্যাংকের মতো টাকাপয়সা সংরক্ষণ বা গচ্ছিত রাখে না এই ব্যাংক। এটি আসলে জেনেটিক তথ্য ব্যাংক। এখানে সংরক্ষিত হয় জেনেটিক তথ্য বা দেশের ভূ-সম্ভূত (Land Race) প্রাকৃতিক বীজ সম্পদ। যদি কোনো কারণে মাঠ থেকে কোনো শস্য বা জাত হারিয়ে যায়, তাহলে জিন ব্যাংকে রক্ষিত নমুনা থেকে তা ফিরে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের গবেষণার প্রয়োজন অনুযায়ী, এসব জাত ব্যবহার ও আদান-প্রদান করা হয়। এ ছাড়া নতুন জাত উদ্ভাবনে এসব জাতের বৈশিষ্ট্য নেওয়া হয় বলেই হয়তো এই সংরক্ষণাগারের নাম জিন ব্যাংক। যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উফশী (উচ্চফলনশীল) জাত এসেছে ঠিকই কিন্তু হারিয়ে যায়নি দেশের ভূ-সম্ভূত প্রাকৃতিক দেশি জাতগুলো।

কবি জসীমউদ্দীনের আমার বাড়ি কবিতায় কবি লিখেছিলেন: ‘আমার বাড়ি যাইও ভ্রমর, বসতে দেব পিঁড়ে, জলপান যে করতে দেব, শালি ধানের চিঁড়ে। শালি ধানের চিঁড়ে দেব, বিন্নি ধানের খই। বাড়ির গাছের কবরী কলা, গামছা-বাঁধা দই। আমাদের দেশি ধানের জাতবৈচিত্র্য সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায় এই কবিতা থেকে। কত শত জাত আর কত বাহারি নাম সেসব জাতের। আজকাল অনেকেই বলে থাকেন একটা সময় দেশে ১০ থেকে ১২ হাজার ধানের জাতের প্রচলন থাকলেও এখন বেশির ভাগই বিলুপ্ত। বিজ্ঞানচিন্তার আয়োজনে তরুণ পাঠকদের সঙ্গে মাসিক আড্ডাতেও এ কথাটি বলেছেন জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী। তবে এ কথায় একটা কিন্তু আছে। আসলেই কি বিলুপ্ত হয়ে গেছে আমাদের দেশি ধানের জাত? আশা করি, সেই প্রশ্নের জবাব মিলবে এই লেখায়।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) তার জন্মলগ্ন (১০ অক্টোবর ১৯৭০) থেকেই সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব জাত সংরক্ষণের কাজ শুরু করে। ১৯৭৪ সালে স্বল্পমেয়াদি রাইস জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি পূর্ণতা পায় ২০০৭ সালের দিকে। বর্তমানে এই  সংরক্ষণাগারে আট হাজার সাত শরও বেশি ধানের জাতের নমুনা সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে একেবারেই স্থানীয় জাত হলো পাঁচ হাজার। প্রতিটি নমুনায় রাখা হয়েছে দুই শ থেকে আড়াই শ গ্রাম বীজ। বছরের পর বছর নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংগ্রহ করে রাইস জিন ব্যাংক সংরক্ষণ করেছে, যে প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। এই জাতগুলো বিজ্ঞানীদের ধ্যান-জ্ঞান। তাঁরা এই জাতগুলো সযত্নে সংরক্ষণ করেন এবং তাঁদের ভবিষ্যত্ গবেষণার রসদ হিসেবে ব্যবহার করেন। এ জাতগুলোর কোনোটি নির্দিষ্ট রোগবালাই-প্রতিরোধী, কোনোটি অভিঘাত সহনশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত যেমন বন্যা, খরা, লবণাক্ততা মোকাবিলায় এ জাতের সম্ভাবনাময় বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে ব্রি একের পর এক নতুন জাত উদ্ভাবন করছে।

তাহলে প্রশ্ন আসে, ১২ হাজার জাতের থেকে সাড়ে আট হাজার সংরক্ষিত থাকলে বাকি জাতগুলো গেল কই? উত্তরটা খুব সহজ! আমরা জানি, এ দেশের একেক অঞ্চলে একই ফসলের বিভিন্ন নাম প্রচলিত। একই জাত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। ফলে দ্বৈত নামের কারণে এই সংখ্যার তারতম্য হতে পারে। এ ছাড়া ব্রির সংরক্ষণ ডেটাবেজে এ ধরনের একাধিক নামের জাতকে নাম ও বৈশিষ্ট্যের সামঞ্জস্যতার ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে একটি নামে পরিচিতি দেওয়ার কারণে সংখ্যার হিসাবে কিছুটা তারতম্য হয়েছে মাত্র। এ ছাড়া জেনেটিক অবচয় বা জেনেটিক ইরোসনের ফলে কিছু জাত প্রাকৃতিক নিয়মেই অবলুপ্ত হলেও এখানে সংরক্ষণ ব্যবস্থার কোনো ভূমিকা থাকে না।

ব্রি রাইস জিন ব্যাংকে বাংলাদেশের সব এলাকার সব ধানের জাতের বীজ সংরক্ষণ করা হয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। এখানে সঠিক তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা আর আলোকমাত্রা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যাতে আগামী দীর্ঘমেয়াদেও এই সংরক্ষিত বীজ জীবিত অবস্থায় (অঙ্কুরোদ্গমক্ষম) থাকবে। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সংরক্ষিত থাকায়, আদি গুণাগুণ অক্ষত রেখে এখনো টিকে আছে দেশি ধানের জাতগুলো। বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা জিন সংরক্ষণাগারগুলোতে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সঠিক তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং আলোকমাত্রা শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব  হয় না। তাই তাদের জাতগুলোর অঙ্কুরোদ্গমের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্রি রাইস জিন ব্যাংক শতভাগ নিরাপদ বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এখানে রয়েছে সার্বক্ষণিক পাওয়ার ব্যাকআপ ও প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান। শত শত বছর আগের বিশেষ কোনো জাতের কোন বৈশিষ্ট্য বা বিশেষত্ব ছিল, তা-ও লিপিবদ্ধ আছে এখানে।

দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যমমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি এই তিন ভাগে এখানে ধানের বীজ সংরক্ষিত হয়। স্বল্প মেয়াদে কাচের জারে ২০-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং ৫৫-৬০ ভাগ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় বীজগুলো সিল করে রাখা হয়। বীজের আর্দ্রতা রাখা হয় ১০-১২ শতাংশ। এখানে বীজগুলো সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছর সংরক্ষণ করা হয়। সংগৃহীত সব বীজের নমুনার এক সেট এই সংরক্ষণাগারে রয়েছে, যেখান থেকে অভিযোজিত বীজ নমুনা মধ্যমমেয়াদি সংরক্ষণাগারেও স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া এখান থেকেই বিতরণ, বর্ধিতকরণ ও পুনরুত্পাদনের জন্য বীজ ব্যবহার করা হয়। পুনরায় উত্পাদন সাপেক্ষে এখান থেকে আবেদনের মাধ্যমে শুধু গবেষণার প্রয়োজনে বিশেষ ধানের জাতের বীজ সংগ্রহের সুযোগ আছে।

মধ্যম মেয়াদে স্বল্প মেয়াদের মতো সিলিকা জেলসহ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকে ০-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বীজগুলোকে সিল করে রাখা হয়। বীজের আর্দ্রতা থাকে ৮-১০ শতাংশ। এখানে বীজগুলো সাধারণত ১৫ থেকে ২০ বছর রাখা হয়। এই সংরক্ষণাগারে ১৫-২০ বছর ধানবীজগুলোর গুণাবলি অক্ষুণ্ন থাকে। তারপর সেগুলো দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণাগারে স্থানান্তর করা হয়। দীর্ঘ মেয়াদে রাইস জার্মপ্লাজমগুলো থাকে মাইনাস ২০-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। যেগুলো সাধারণত ৫০ থেকে ১০০ বছর ভালো থাকে। এভাবে তিনটি ধাপে চক্রাকারে সংরক্ষিত থাকে বীজের অঙ্কুুরোদ্গম ক্ষমতা।

ব্রি জার্মপ্লাজম সেন্টারের ধানের জাতের নমুনার এক সেট সংরক্ষিত আছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) জিন ব্যাংকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোট প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার ধানবীজের নমুনা সযত্নে সংরক্ষিত আছে সেখানে। এ ছাড়া নরওয়ের গ্লোবাল সিড ভল্টেও এক সেট সংরক্ষিত আছে। ফলে দেশি জাতের হারিয়ে যাওয়া বা বিলুপ্ত হওয়ার ধারণা অবান্তর। মাঠে কোনো জাতের বীজ হারিয়ে গেলেও এই জিন ব্যাংক থেকে সেই বীজ কখনোই হারিয়ে যাবে না। এভাবে বিলুপ্তির হাত থেকে কৃষি বিজ্ঞানীরা ধানবীজ রক্ষা করে চলেছেন।

ব্রির রাইস জার্মপ্লাজম সেন্টার বা জিন ব্যাংক সম্পর্কে কৌলিসম্পদ ও বীজ বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধির ফলে উফশী জাতের ভালোমানের ধান উদ্ভাবন করা হচ্ছে। ব্রিডিং সাইকেল শর্ট করতে জিন ব্যাংকের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মার্কারি অ্যাসিস্ট্যান্স সিলেকশন পদ্ধতি ব্যবহার করে কম সময়ে জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এ ছাড়া সংরক্ষিত জিনকে কাজে লাগিয়ে জীবন-রহস্য উন্মোচনও করা হচ্ছে। ইরির বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত তিন হাজার ধানের জাতের জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন, যেখানে বাংলাদেশের ১৮৬টি জাত আছে। এতে বিভিন্ন ঘাত সহনশীল উফশী ধানের জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া উদ্ভাবিত এসব জাতের ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

ধান ছাড়াও কৃষিসংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১৩৮টি ফসলের ১৮ হাজার ১২৯টি শস্য জিন মজুত আছে। অন্যান্য ফসলের মধ্যে খাদ্যশস্যের ১ হাজার ৭২৭, ডালজাতীয় ফসলের ৩ হাজার ৪৬০, তেলজাতীয় ফসলের ৪৫৫, সবজির ৩ হাজার ৯০২, মসলার ১৯৯, ফলের ১৭০, রুট অ্যান্ড টিউবারের ৯২, আঁশজাতীয় শস্যের ৬০টি জিন মজুত রয়েছে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে ২০টি মেডিসিনাল ও অ্যারোমেটিক উদ্ভিদজাত শস্যের জিন রয়েছে। এসব জিন ব্যবহার এবং গবেষণার মাধ্যমে ২৮টি গমের, ১১টি হাইব্রিডসহ ১৯টি ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করেছে বিএআরআই।

এ ছাড়া কন্দাল ও উদ্যানজাতীয় ফসলের মধ্যে আলু, মিষ্টি আলু, কচু ও সবজির বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন করা গেছে। এর মধ্যে ৫৬টি উচ্চফলনশীল আলু, সবজিজাতীয় ২৯ ফসলের মোট ৮৫টি উচ্চফলনশীল জাত, ডালজাতীয় ছয় ধরনের ফসলের ৩১টি উচ্চফলনশীল জাত, তেলজাতীয় আটটি ফসলের ৪০টি উচ্চফলনশীল জাত, ২৬ ধরনের ফলজাতীয় ৬২টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিএআরআইয়ের মসলা গবেষণা কেন্দ্রেও পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আদা, হলুদ ইত্যাদি ফসলের ২২টি জাত এবং ফুলের ১৬টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।

লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর