সোনাভানের সোনা মণিদের

বগুড়ার বন্ধুরা ঘাড়ে তুলে নিচ্ছেন ত্রাণসামগ্রীর ভারী বস্তা। তাঁদের দ্রুত পৌঁছাতে হবে বন্যাদুর্গত মানুষের মধ্যে। সারিয়াকান্দি–কালিতলা গ্রোয়েন বঁাধ এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন সোয়েল রানা
বগুড়ার বন্ধুরা ঘাড়ে তুলে নিচ্ছেন ত্রাণসামগ্রীর ভারী বস্তা। তাঁদের দ্রুত পৌঁছাতে হবে বন্যাদুর্গত মানুষের মধ্যে। সারিয়াকান্দি–কালিতলা গ্রোয়েন বঁাধ এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন সোয়েল রানা

চারদিকে অথই পানি। যেন নদীর স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মা সোনাভান বেগম তাঁর সন্তানদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন। এলাকার সব বাড়িঘরে পানি উঠেছে। কোনো কোনো বাড়ি বন্যার তোড়ে ভেসে গেছে।

দুপুর ১২টার দিকে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু সেখানে কোনো ঠাঁই নেই। মানুষে গিজগিজ করছে। সোনাভানের স্বামী তখন কুমিল্লায়। এটা ১২ আগস্টের ঘটনা। বিপদ দেখে সোনাভানের কান্না চলে আসে। থাকার জায়গা না পেয়ে তিনি আবার বাড়ির দিকে রওনা দেন। মাঠঘাটে থইথই পানি।

ছোট মেয়ে মিম আক্তার (৭)। মা তাকে নিলেন কাঁধে। ডান হাতে শক্ত করে ধরলেন মেজ ছেলে শরিয়তুল্লাহরকে (৯)। আরেক হাতে ধরলেন সোনাভানের স্বামী আবদুর রহমানের ভাতিজা নূর মোহাম্মদের (১১) হাত। বড় মেয়ে রুমিসা পড়ে ক্লাস সেভেনে। ক্লাস ফাইভে সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। রুমিসা পেছনে পেছনে তার মায়ের আঁচল ধরে সাবধানে পা ফেলে।

প্রথমে হাঁটুপানি। পরে কোমরপানি। আস্তে আস্তে পানির গভীরতা বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে গলাপানি হয়ে যায়। হঠাৎ পানির তীব্র স্রোত এসে ডুবিয়ে ফেলল তাঁকে।

সোনাভান পানি থেকে মুখ তুলে দেখলেন, তাঁর দুই হাতের দুই ছেলে নেই। কাঁধে বসা মিম নেই। আঁচল ধরা রুমিসাও নেই!

চিত্কার করতে থাকেন সোনাভান।

পাঠক, পরের অংশটুকু না বলতে পারলেই ভালো লাগত। ...কিন্তু।

ঘণ্টাখানেক পরে পাওয়া গেল চারজনের লাশ। বন্যা লাশ বানাল চারজনকে। ঘটনা দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার।

রুমিসার মা এখন শোকে শয্যাশায়ী। এ ঘটনার পাঁচ দিন পর আবদুর রহমান এসেছিলেনপ্রথমআলোর দেওয়া ত্রাণ নিতে। বুকফাটা আর্তনাদ তাঁর। ‘হামার বুক খালি হয়া গেছে।’

বুক খালি করে দিয়েছে তাঁকে এবারের বন্যা। তাঁর বুকের হাহাকার কেউ কি থামাতে পারবে!

সোনাভান বেগম
সোনাভান বেগম

.

‘হাসি ফোটানোর সময় এখন’ শিরোনামটি ছিল গত সংখ্যার বন্ধুসভার পাতায়। বন্যা শুরু হওয়ার পরপরই আমাদের বন্ধুরা ত্রাণকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সিলেটের বন্ধুরা হাওর-আফাল ইত্যাদি পেরিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন দুর্গম এলাকায়। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে দুর্গত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেছেন। বন্ধুরা কথা রেখেছেন। তাঁরা বন্যাদুর্গত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যে কয়েকটি জেলায় বন্যা হয়েছে, সেখানেই প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ত্রাণকাজে। অনেক বন্ধু নিজেদের মধ্যে অর্থ সংগ্রহ করেও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

আমাদের বন্ধুরা হাজারো বন্যার্ত মানুষের হাতে নানা রকম ত্রাণসামগ্রী তুলে দিয়েছেন।

নরসিংদী থেকে বন্ধুরা ত্রাণ দিতে চলে যান জামালপুরে। ফেনীর বন্ধুরা তাঁদের সংগৃহীত অর্থ দিয়েছেন ত্রাণ তহবিলে।

ঢাকা থেকে গিয়ে দুর্গত এলাকার বন্ধুদের ত্রাণ বিতরণে সহায়তা করেছেন আবু আবদুল্লাহ, নাফিউর রহমান নূর, সৈকত বরণ শীল, আসিক আলী, হাসান মাহমুদ, রেদোয়ান মাহমুদ ও সজল কুমার।

বন্ধুদেরএবারেরঈদ

ঈদ মোবারক। বন্ধুরা, আমাদের এবারের ঈদটা কি একটু অন্য রকম হতে পারে না? আমরা তো ঈদের দিনে সেমাই-পায়েস থেকে শুরু করে নানান রকম খাবার খাই। আমরা কি এবার এসব খাবার নিয়ে অন্তত একটি পরিবারে যেতে পারি না?

বানভাসি লাখো মানুষ! অনেকের ঘরে চাল-ডাল কিছুই নেই। সেখানে ঈদের মজাদার খাবারের কথা তো ভাবাই যায় না। আমরা ঈদের আনন্দ উপভোগ করব। আর ওরা হবে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত?

এটা আমরা হতে দিতে পারি না।

চলেন বন্ধুরা, ঈদের খাবার নিয়ে অন্তত যেকোনো একটি অসহায় পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাই। এটাই হোক বন্ধুদের এবারের ঈদ।

লেখক: সভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ।