তোমাকে অভিবাদন মোনালিসা

আফসানা ইয়াসমিন মোনালিসা
আফসানা ইয়াসমিন মোনালিসা

এসএসসি পরীক্ষা। বইমেলা চলছে আর সেই সময়েই কিনা পরীক্ষা শুরু হলো! আফসানা ইয়াসমিন মোনালিসা পরীক্ষা দেয় আর বইমেলার নানা দৃশ্য তার চোখে ভেসে ওঠে। বাংলা একাডেমির বইমেলা। শত শত বইয়ের স্টল। শত শত নতুন বই। বাংলা একাডেমির নতুন বইয়ের ঘ্রাণ মোনালিসা যেন মিরপুর থেকে টের পায়। মোনালিসাদের বাসা মিরপুরে।

ভাবনার মধ্যে ঘুরপাক খায়—সে বই কিনছে। প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নিচ্ছে। মোনালিসা তার মা-বাবাকে বলল, সে বইমেলায় যাবে। বাবা-মা অবাক হলেন। এই পরীক্ষার মধ্যে কী করে যাবি। রেজাল্ট খারাপ হবে যে। সে ভাবল, অর্ধেক পরীক্ষা হয়ে গেলে বইমেলায় যাবে।

মোনালিসা ভালোবাসে বই পড়তে। নিয়মিত বই পড়ে। জানতে চাইলাম, ‘কবে থেকে তুমি বাংলা একাডেমির বইমেলায় যাও?’

‘আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি, ২০০৪-এ। তখন থেকে।’

আর এখন মোনালিসা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ক্লাস থ্রি থেকে এ পর্যন্ত একবারও বইমেলা মিস হয়নি।

এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো ২৭ ফেব্রুয়ারি। ২৮ তারিখে কেউ আর মোনালিসাকে ফেরাতে পারল না। বান্ধবীরা মিলে মিরপুর থেকে রওনা দিল বইমেলার দিকে। সে কী আনন্দ তার।

যাওয়ার আগের ঘটনা বলি। মোনালিসা মা-বাবাকে বলল, ‘টাকা দাও মেলায় যাব।’ বাবা-মা টাকা দিতে রাজি হলেন না। কিন্তু তাহলে মেলায় গিয়ে কী লাভ? তার নিজের কাছেও কোনো টাকা নেই। তাহলে কী করবে মোনালিসা?

‘টাকা পেলে কোথায়?’

‘আমাদের মিরপুরে চুল কিনতে আসে লোকজন। আমার কানে ভেসে এল—চুল আছে, চুল! চুল বিক্রি...! এ রকম ডাক আমার কানে এল। আমি দাঁড়ালাম ড্রেসিং টেবিলের সামনে। আমি সামান্য ঘুরে দাঁড়ালাম। দেখলাম, আমার চুল কোমর ছাড়িয়ে গেছে। ডাকলাম সেই লোকগুলোকে।’

‘মানে?’

‘হ্যাঁ, মানেটাই বলছি। আমি আমার চুলগুলো বিক্রি করে দিলাম। নিজ হাতে চুল কেটে ফেললাম। কোমর পর্যন্ত চুল কাঁধ বরাবর হয়ে গেল। এটা ২০১২ সালের কথা।’

এবার মোনালিসা আমাকে প্রশ্ন করে।

‘চুল বড়, না বই বড়?’

বলি, ‘লম্বার দিক থেকে তো চুলই বড়।’

ও হাসে। বলে, ‘চুল বড় হলে কি কেউ চুল কেটে ফেলে? আমার কাছে বই-ই বড়।’

‘কত বিক্রি হলো চুল?’

‘ওরা ওজন করে বলল, বারো শ টাকা। আমি দামাদামি না করে টাকাটা নিয়ে নিলাম। তারপর ছুটলাম বইমেলায়। ইচ্ছেমতো ঘুরলাম। ইচ্ছেমতো বই কিনলাম। জানেন, লোকগুলো আমাকে ঠকিয়ে দিয়েছে। অনেকে বলেছে, ওই চুলের দাম নাকি আরও বেশি হওয়ার কথা। ইশ, তাহলে আরও বই কিনতে পারতাম।’

এই হলো আমাদের মোনালিসা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধু। গত সপ্তায় বসেছিলাম ওদের সঙ্গে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আঠারোজন বন্ধু এসেছিল কারওয়ান বাজার বন্ধুসভার কক্ষে।

দীর্ঘ আড্ডা ওদের সঙ্গে। আড্ডায় সংগঠন নিয়ে সব কথাবার্তা। আড্ডার শেষের দিকে বই পড়া নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি জানতে চেয়েছিলাম, আগামী দুই মাসের মধ্যে কারা কারা বই কিনবে? সতেরোজনই হাত তুলল। একজন বন্ধু কিছুতেই হাত তুলছে না।

এ দৃশ্যে মোনালিসার নিশ্চয় মন খারাপ হয়েছিল। তারপর বেড়িয়ে এল তার মনের কথা। বইমেলার কথা, বই কেনার কথা, চুল বিক্রির কথা।

‘এবার বই কিনলে কীভাবে?’

‘না, আর চুল কাটা লাগবে না। এখন তো আমি টিউশনি করি। এবার দুই হাজার ২০০ টাকার বই কিনেছি।’

আমি হাত কপালে ঠেকিয়ে বললাম, মোনালিসা তোমাকে অভিবাদন বন্ধু।

সভাপতি: প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ