অবিশ্বাস

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘ভাগ্যের ডাক্তার ভাগ্যটা দেখে বলে ভাগ্য তোমার অতি চমৎকার’ গানটা শুনেছিস? শেখ ইশতিয়াকের। নব্বইয়ের দশকের গান। আমার বড় ভাইয়া শুনত দিনরাত। আমারও শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে। ব্যাপারটা মজার, না? এ রকম একটা ডাক্তার পেলে মন্দ হতো না, কী বলিস?’

ক্যানটিনে বসে আমরা তিন বান্ধবী মিলে সমুচার সঙ্গে মজাও উপভোগ করছি। মেডিকেলের প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে মাসখানেক হলো। সব স্যারকেই ঠিকমতো চিনি না। তবে আমরা তিনজন মিলে ভালোই একটা গ্রুপ বানিয়ে ফেলেছি।

‘আছে তো। এ রকম একজন আছে। ভাগ্যও দেখে, আবার ডাক্তার এই হয়ে গেল প্রায়।’

জেনি আর সিমি অনেক ফাস্ট। লাইব্রেরি, ক্যানটিন, টিএসসি ভেজে খেয়েছে এই একটা মাস। আমি তো ক্লাস শেষ হলেই বাসায় দৌড়। ওরা নাকি প্রতিদিন বিকেল পর্যন্ত ‘লাইব্রেরি ওয়ার্ক’ করে। বড় ভাইয়াদের সঙ্গে পরিচয় এরই একটা ফল।

‘কে? কার কথা বলছিস?’

‘রাসেল ভাইয়া। শেষ বর্ষে পড়ে। তাঁদের ব্যাচের সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করে। খুব ভালো হাতও দেখে। তোর সেই ভাগ্যের ডাক্তার।’

‘কোন রাসেল ভাই? বাসা কোথায়?’

‘তুই চিনবি না। পুরান ঢাকায় নাকি বাসা। আজ বিকেল পর্যন্ত থাক, পরিচয় করিয়ে দেব। ভাইয়া লাইব্রেরিতে খুব রেগুলার।’

একটা নতুন অভিজ্ঞতার আশায় আমি থেকে গেলাম। দুপুরের পরে দেখাও পেয়ে গেলাম। দৃষ্টি বিনিময়ে একটা কথা চালাচালি হয়ে গেল, গোপনে।

‘আরে জেনি, কেমন আছ?’

‘ভালো ভাইয়া। আমার ফ্রেন্ড সুমি। পরিচিত হতে এসেছে।’

‘ও সুমি! কেমন আছ?’

আমি ইশারায় সালাম দিলাম।

‘ভাইয়া, ও নাকি হাত দেখাবে। একটু সময় দেবেন?’

‘বেশ তো। দেখি হাত।’

কাঁপা কাঁপা হাতটা নিয়ে রাসেল ভাই গবেষণায় নামলেন।

‘তোমার বাসা পুরান ঢাকায়। ওয়ারী নাকি? বার্থ ডে মার্চে মনে হয়?’

ওমা! হাতে এত কিছুও লেখা থাকে নাকি? জেনিরা তো অবাক। আমি মুচকি হাসছি।

‘গত বছর দার্জিলিং গিয়েছিলে। একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়। বড় কোনো ক্ষতি হয়নি অবশ্য।’

আমার একটু বিরক্ত লাগছে। লেখা থাকলেই সব বলতে হয় নাকি?

‘তোমার বৃষ্টি খুব প্রিয়। রাতের বেলা বৃষ্টি হলেই চলে যাও ছাদে। হাতে কফি। “এসো নীপবনে” গানটা সবচেয়ে প্রিয়’।

আমার চোখে অবিশ্বাস। একটু রাগও হচ্ছে। এসব ব্যাপার আমার কাছে অমূল্য গোপন।

‘একটা ছেলেকে ভালোবাসো। মেডিকেলে পড়ে মনে হয়?’

এটা বাড়াবাড়ি। আমি কি হাতটা ফিরিয়ে নেব? আমার চোখটা জ্বালা করছে।

‘একদিন সন্ধ্যায় সেই ছেলেটার হাত ধরে গান শুনিয়েছিলে, “ভালোবাসি ভালোবাসি”।’

আমি চট করে হাতটা টেনে নিয়ে চলে আসি। কান্না লুকাতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমার। গাড়িতে বসে কাচটা উঠিয়ে ভেঙে পড়ি কান্নায়।

রাসেল ভাইয়া, তুমি এতটা প্রতারক? তুমি আব্বুর বন্ধুর ছেলে। ছোটবেলা থেকে তোমাকে চিনি। একটা সময় ভালোবেসে ফেলি। আমার সব ভালোলাগা, প্রিয় মুহূর্ত, কিছু গোপন স্মৃতি তোমাকে বলেছি।

তুমি না সারাটা জীবন আমার পাশে থাকবে? আমাকে আগলে রাখবে। খুব ভালোবাসবে। বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, নির্ভরতায় বেঁচে থাকবে আমাদের সম্পর্ক। অথচ কয়েকটা গোপন কথার মূল্য দিতে পারলে না তুমি? এতটা বিশ্বাসঘাতকতা করলে আমার সঙ্গে!

এতটা বিশ্বাসহীনতা নিয়ে একটা জীবন কি আমি তোমার সঙ্গে পার করতে পারব, বলো?