ফেলে আসা দিনগুলো ডাকে পেছনে...

প্রথম আলোর চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বরিশাল বন্ধুসভার অনুষ্ঠানে বন্ধুরা
প্রথম আলোর চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বরিশাল বন্ধুসভার অনুষ্ঠানে বন্ধুরা
আমাদের এবারের সংখ্যায় প্রকাশ হলো তিনজন পুরোনো বন্ধুর লেখা। বন্ধুরা বলেছেন বন্ধুসভায় তাঁদের স্মৃতির কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার মহিউদ্দিন মাহিম, বরিশাল বন্ধুসভার সুপা সাদিয়া ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধু সংগীতা আচার্য্য। চলুন শোনা যাক তাঁদের কথা।


হ্যালো, বন্ধুসভা থেকে বলছি

চলুন টাইম ট্রাভেল করে আসি। বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে শুনুন...

তখন প্রতি বুধবার আমরা বসতাম ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দায়, পরে শহীদ মিনারের পাদদেশে। বন্ধুসভার আড্ডাগুলো এত প্রাণবন্ত ছিল যে কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যেত, খেয়ালই থাকত না। মাদকবিরোধী সমাবেশ, অ্যাসিডবিরোধী সমাবেশ, পাখিমেলা, লেখাজোখা কর্মশালা—যা কিছু ভালো, কী করিনি আমরা? আহ্! সেই দিনগুলো।

একদিন হুট করে রওশন ভাই হাজির সঙ্গে ডা. মোহিত কামাল। ১০ মিনিটের নোটিশে আমরা জনা পঞ্চাশ সেন্ট্রাল মাঠে। সেই আড্ডায় জন্ম হলো ‘সবুজ চত্বর পাঠচক্র’। ডা. মোহিত কামাল ভাইয়ের আর্থিক সহায়তায় প্রতি মাসে আমরা একটা করে পাঠচক্র করতাম। মনে পড়ে, মহুয়াতলায় ঘাসের ওপর বসে খাঁচা বইয়ের পাঠচক্রে আলোচক হিসেবে ছিলেন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্বয়ং।

স্বাধিনী নামের আট বছর বয়সী একটা মেয়ে, মা গার্মেন্টসকর্মী, ৩৫ শতাংশের ওপর পুড়ে গিয়েছিল ওর শরীর। বন্ধুসভার মাধ্যমে আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে আসেন সুহৃদেরা। প্রায় তিন মাস বার্ন ইউনিটে রেখে ওর চিকিৎসা দিয়েছিলাম আমরা। এক বছরের বেশি সময় ফলোআপ করা হয়েছিল।

সেবার জাবিতে পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনারে প্রথম একুশের অনুষ্ঠান হবে। আমরা ক্যাম্পাসে চা বিক্রি করে এমন ১০টি শিশুকে শুদ্ধ উচ্চারণ শেখালাম, বন্ধুসভার হয়ে ওরা কবিতা পড়ল।

বন্ধুসভার গল্প লিখে শেষ হবে না। নাচ, গান, দেয়ালিকা, ম্যাগাজিন, নাটক, কুইজ, বিতর্ক, র‍্যালি, বনভোজন, নৌভ্রমণ, ঢাকা বন্ধুসভা ও ঢাবি বন্ধুসভার সফর—একসময় জাবি ছেড়ে, উচ্চশিক্ষার্থে দেশও ছেড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি প্রাণের সংগঠন হতে।

এবার পয়লা বৈশাখের আগে একটা ফোনকল: হ্যালো, বন্ধুসভা থেকে বলছি—মুহূর্তেই একরাশ ভালো লাগা ঘিরে ধরে। তারুণ্য ৬ষ্ঠ সংখ্যা পাওয়ার পর থেকেই ভাবছিলাম যাব, যাব।

দাঁড়িয়ে আছি প্রথম আলো অফিসের সামনে। আহা, কত স্মৃতি, কত কথা, কত এসেছি এখানে। আজ সেখানে নতুন মুখ, ওরা কি বুঝবে আমাদের আবেগ? বন্ধুসভা বলতে এখনো যে আলোড়ন ওঠে হৃদয়ে, তার স্পন্দন থেমে যাবে না তো আজকের পর?

এসব ভাবতে ভাবতে ঢুকি বন্ধুসভা কক্ষে। তখন চমৎকার ফেসবুক লাইভ চলছিল। লাইভ শেষে সবার সঙ্গে পরিচিত হতে হতে আমি কখন যে ওদের একজন হয়ে গেলাম, নিজেই জানতে পারিনি।

বলছিলাম টাইম ট্রাভেলের কথা। এক যুগ আগের আমাকে একনিমেষে খুঁজে পেলাম বন্ধুসভায় এসে, এটা কম টাইম ট্রাভেল নয়?

এত ভালো লাগল যে মনে হচ্ছে সব পুরোনো বন্ধুকে ডেকে বলি, বন্ধুরা, এসো, সময় ওখানে চিরসবুজ হয়ে আছে।

সংগীতা আচার্য্য

সাবেক সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা

স্মৃতি জাগানিয়া

১৯৯৮ সালে ৪ নভেম্বর থেকে প্রথম আলো প্রতিদিন সকালে আমাদের বাসার দরজায়। ১১ নভেম্বর বের হয় বন্ধুসভা পাতা। সেখানে সদস্য আহ্বান। আমি কিছু না ভেবে ফরম পূরণ করে পাঠিয়ে দিলাম। বন্ধু নম্বর এল ৭৭২।

তখন প্রথম আলোর দক্ষিণাঞ্চলীয় বিশেষ প্রতিনিধি আমার বাবা অধ্যাপক বদিউর রহমান। তাঁর কাছে এক সকালে এলেন শওকত আলী হিরণ ও নূর মোহাম্মদ ফোরকান। তাঁরা বাবাকে এসে জানালেন বরিশালে বন্ধুসভা করতে চান। তাঁরা দুজনই বন্ধু নম্বর পেয়েছেন। বাবা আমাকে ডাকলেন। পরিচিত হলাম। শুরু হলো বন্ধুসভা।

 ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শওকত আলী হিরণ আহ্বায়ক ও নূর মোহাম্মদ ফোরকান এবং আমি যুগ্ম আহ্বায়ক। শুরু হলো বরিশালে বন্ধুসভার পথচলা। শুরুতেই তারা প্রথম আলো সহায়ক তহবিলে অর্থ সংগ্রহ, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ, ডায়রিয়া প্রতিরোধে বিভিন্ন বস্তিতে খাওয়ার স্যালাইন বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের সামনের রাস্তা সংস্কার, অ্যাসিড বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোসহ নানান কর্মকাণ্ডে মুখর ছিল। বরিশাল সভার বন্ধুরা রিকশাশ্রমিকের ৫ বছরের সন্তান ক্যানসার আক্রান্ত শিশু মিরাজের চিকিৎসার ভার প্রায় ১ বছর বহন করেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার একটি অনুষ্ঠানে বন্ধুরা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার একটি অনুষ্ঠানে বন্ধুরা

আমি ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বরিশাল সভার অর্থ সম্পাদক, দুই দফায় সাধারণ সম্পাদক (১৩ নভেম্বর, ২০০০-১৯ এপ্রিল, ২০০৩) এবং সহসভাপতি (২০০৩-২০০৪) ছিলাম। এরপর ঢাকায় বসবাস। বরিশালের গুণীজনেরা বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত নিখিল সেন, প্রকৃতি গবেষক দ্বিজেন শর্মা, ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন, নারীনেত্রী রানী ভট্টাচার্য, ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন, সাংস্কৃতিজন মানবেন্দ্র বটব্যাল, মিন্টু বসু, দীপংকর চক্রবর্তী, সাইফুর রহমানসহ অনেকে। আর নিয়মিত দিকনির্দেশনা দিতেন তখনকার প্রথম আলোর বরিশাল প্রতিনিধি তৌফিক মারুফ। আর সে সময়ের বন্ধুদের মধ্যে বেশ সক্রিয় ছিলেন জাহিদুল ইসলাম, হোমায়রা আক্তার, ওয়ালিয়া মুন্নী, জুলিয়েট রোজেটি, হাসনাইন পারভেজ, সিরাজুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম, শেখ ওবায়েদুল্লাহ মাসুদ, হিশাম খান, নেজারুল বাবু, চিন্ময় আইচ, মোশরেবা কলি, সৌরভ মাহমুদসহ আরও অনেকে।

সুপা সাদিয়া

গবেষক ও সংস্কৃতিকর্মী, সদস্য বরিশাল বন্ধুসভা

পড়ার ক্যাম্পাস, পড়ানোর ক্যাম্পাস

২০০৫ সাল। মফস্বলের বোকাসোকা একটি ছেলে। হঠাৎ কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ১০২২ ক্লাসরুমে এসে পড়ল তা আজও আমার কাছে বিস্ময়ের।

 লালিত স্বপ্ন যখন নিজের হাতে এসে ধরা দেয়, তখন তা আর ব্যক্ত করা যায় না। কেবল আনন্দে আর বিস্ময়ে তা অনুভব করতে হয়। আমার বেলায়ও সে রকম কিছু হয়েছিল। প্রথম ক্লাসেই শুভ্র বসন ও শুভ্র কেশের প্রফেসর নজরুল ইসলাম স্যার এসে ইংরেজি ভাষায় ৪৫ মিনিটের যে লেকচার দিলেন, তাতে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। ভাগ্যিস কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের বইয়েরা আমার পাশে ছিল। এভাবে শুরু করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যাত্রা। তারপর একে একে বিতর্ক, কবিতা, বন্ধুসভা ও নানা সামাজিক সংগঠন—সবই করেছি। বিতর্ক আর বন্ধুসভাকে ধ্যানজ্ঞানই মনে করেছিলাম একসময়। সারা দিন কলা ভবনের ক্লাস থেকে গ্রন্থাগার, গ্রন্থাগারের সামনে জমিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর চা, হাকিমে ঘুরে বেড়ানো এবং দুপুরে টিএসসিতে দল বেঁধে সস্তায় অমৃত খাবার। তারপর আবার শরীরে পূর্ণ শক্তি নিয়ে বিতর্ক কিংবা বন্ধুসভার কোনো কাজের জন্য বেরিয়ে পড়া। অথবা দরকারি কোনো কাজে মনোনিবেশ করা। আর সন্ধ্যা হলে টিউশন তো আছেই। আর যদি কোনো কাজই না থাকে তাহলে সমস্যা কী? সন্ধ্যায় তো ক্যাম্পাসে ঈদ! এভাবে সূর্যের আলোর মতো একসময় আমার ছাত্রত্বের আলো নিভে গেল।

সমস্ত কাজের মাঝে শেষ পর্যন্ত শিক্ষকতাটা মুখ্য হয়ে গেল। চলে এলাম প্রকৃতির লীলাভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু স্থল অধ্যাপনা। প্রধানতম কাজ অধ্যাপনা হলেও কাজ কেবল অধ্যাপনায় সীমাবদ্ধ থাকে না। নানা ধরনের সামাজিক, সাংগঠনিক ও পরার্থকাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হয়। জারুলতলা থেকে বুদ্ধিজীবী চত্বর। মুক্তমঞ্চ থেকে শহীদ মিনার। গোলচত্বর থেকে ঝুপড়ি অথবা সমাজবিজ্ঞান মিলনায়তন।

মহিউদ্দীন মাহিম

সহকারী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য, প্রথম আলো বন্ধুসভা