মিলন ভাইয়ের বিশ্বকাপ

মিলন ভাইকে তো আপনারা চেনেন। ওই যে, বিশ্বকাপের আগে পুরো বাড়ি প্রিয় দলের পতাকার রঙে সাজিয়েছিলেন। আর বাড়ির ছাদে সেই দেশের সবচেয়ে বড় পতাকা টাঙিয়েছিলেন। পত্রিকায় ছবি এসেছিল তো। এই গল্প সেই মিলন ভাইয়ের।

আমাদের গ্রামে প্রতি ঈদ আর বিশ্বকাপ এলেই প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়। মজার কায়দায় সাজানো হয় দুটি দল। যেমন বিবাহিত বনাম অবিবাহিত, শ্যালক বনাম দুলাভাই, মেয়ের বাপ বনাম ছেলের বাপ এসব আরকি। তবে যেভাবেই দল সাজানো হোক না কেন, জার্সি অবধারিতভাবে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। আমাদের চেয়ারম্যান আজন্ম আর্জেন্টিনার সমর্থক। আর পাশের গ্রামের শিল্পপতি আজিজ সাহেব ব্রাজিলের সমর্থক। সম্পর্কে তাঁরা আবার ভায়রা।

গল্পটা ১৯৯৮ সালের। আমাদের খেলাটা হবে ফাইনালের দিন বিকেলে। এর আগের দুই ঈদে আমাদের আর্জেন্টিনা হেরে গেছে। সেই বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনা বাদ পড়ে গেছে, আর ব্রাজিল উঠে গেছে ফাইনালে। চেয়ারম্যানের চেহারায় অন্ধকার। এদিকে গ্রামে খেলা জমে গেছে। আর্জেন্টিনা ২-০তে এগিয়ে। আমরা তো তালি, শিস দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের মধ্যে শুধু মিলন ভাইকে দেখা যাচ্ছে না।

মিলন ভাই আজিজ সাহেবের ভাগনে। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। মাস ছয় বাকি আছে বোধ হয় স্নাতক শেষ করতে। মাঝমাঠের তুখোড় খেলোয়াড় মিলন ভাই আগের রাতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন খেলবেন না। কিন্তু, কেন?

খেলা শেষ। আর্জেন্টিনা জিতে গেছে। চেয়ারম্যান খুশিতে লাফাচ্ছেন। এমন সময় খবর এল, তাঁর মেয়ে টিনা উধাও। সবাই যখন খেলায় মেতেছিল, তখন বাসা থেকে পালিয়েছেন টিনা। অথচ আমরা জানি, চেয়ারম্যানের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহেই অনুষ্ঠান। তাহলে কি অন্য কাউকে পছন্দ করেন টিনা? তাঁকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল? পছন্দের ছেলেটা কি মিলন ভাই? গ্রামের বাতাস গুজব ছড়ানোর জন্য খুব ভয়ংকর।

রাত হয়ে গেছে। এদিকে ফাইনাল খেলাও শুরু। ব্রাজিল বনাম ফ্রান্স। চেয়ারম্যান সাহেবের আজ আর কোনো খেলা নেই। মেয়ে আর সেই ছেলেকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবেন, এমনই মনে হচ্ছে। একসময় খবর আসে, বাস স্টেশনের কাছে দেখা গেছে দুই অপরাধীকে। বিশ্বকাপ রেখে আমরা সবাই সেখানে। মিলন ভাইকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন তাঁরা।

চেয়ারম্যানের হাতে সাবেকি আমলের বন্দুক। মিলন ভাইয়ের দিকে তাক করা। টিনাকে ধরে বাসায় পাঠানো হয়েছে। ট্রিগারে চাপ পড়ার আগে উল্লাস, তালি। ‘চেয়ারম্যান সাহেব, ব্রাজিল হেরে গেছে’। খবরটা শুনে একটা হাসির আভা দেখা গেল তাঁর মুখে। তুখোড় খেলোয়াড় মিলন ভাই ঠিক তখনই চিৎকার করে উঠলেন, ‘চাচা, আমি আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। একটু কনসিডার করা যায় না?’

২০১৮। আর্জেন্টিনা রঙে রাঙানো বাড়ির ছাদে মনমরা বসে আছেন মিলন ভাই। তাঁর বউ অবশ্য খুব খুশি। হাতে চা নিয়ে টিনা ভাবি তাড়া দিলেন, ‘কী হারু পার্টি, আমাদের খেলা শুরু হয়ে গেছে। নিচে আসো।’

চিকিৎসক। প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্য