বিশ্বকাপের স্বেচ্ছাসেবীরা

বিশ্বকাপে রাশিয়ায় স্বেচ্ছাসেবকেরা। ছবি: ফিফা ডট কম
বিশ্বকাপে রাশিয়ায় স্বেচ্ছাসেবকেরা। ছবি: ফিফা ডট কম

বিশ্বকাপে রাশিয়ানদের বন্ধুবৎসলতা নিয়ে খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল না। কিন্তু মস্কোতে গিয়েই পাল্টে গেল এত বছরে আমার কল্পনায় জমানো রাশিয়ানদের প্রোফাইল পিকচার। এই বিশ্বকাপে সারা পৃথিবী থেকে ২০ লাখের বেশি পর্যটক এসেছেন রাশিয়ায়। আমার বিশ্বাস, আমার মতো সবাই আতিথেয়তা, বন্ধুত্ব আর সৌন্দর্যের অন্য রকম রাশিয়ার মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে যাবেন।

বিশ্বকাপের আয়োজন নিখুঁত, সুন্দর, পরিপাটি, চোখধাঁধানো। মাঠে, মাঠের বাইরে, মুগ্ধতা সবখানে। তবে আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছেন বিশ্বকাপের স্বেচ্ছাসেবীরা। দেশি-বিদেশি কোটি পর্যটক আর ফুটবল-ভক্তদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন লাল-নীল বিশ্বকাপ-বন্ধুরা। বিশ্বকাপে রাশিয়ার ১১টি হোস্টসিটিতে ১৭ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। খেলায় বল যখন মাঠের বাইরে চলে যায়, সঙ্গে সঙ্গেই মেসি-নেইমারদের হাতে আরেকটি বল তুলে দেন তাঁরা।

 বিশ্বকাপের মাঠে ফুটবলের মহা তারকাদের কাছাকাছি কাজ করার ব্যাপারটি নিশ্চয়ই রোমাঞ্চকর। তবে তাঁদের সব কাজ এত আরামের নয়। ড্রেসিরুম থেকে গ্যালারি, বিমানবন্দর থেকে শপিং মল, রেস্তোরাঁপাড়া থেকে রেলস্টেশন—সব খানেই আছেন বিশ্বকাপের স্বেচ্ছাসেবীরা। রাশিয়ায় ভাষা একটা সমস্যা। এর সমাধানও তাঁরাই। কাউকে কিছু বোঝাতে হবে, দোকানির সঙ্গে দরদাম করতে হবে, ঠিকানাটা খুঁজে পাচ্ছি না, ট্রেনের টিকিট কাটতে হবে কিংবা খাবার মেন্যুটা অপরিচিত লাগছে—এসব সমস্যায় সব সময় পাশে আছেন বিশ্বকাপ-বন্ধুরা।

লেখকের সঙ্গে রাশিয়ার দুই স্বেচ্ছাসেবক
লেখকের সঙ্গে রাশিয়ার দুই স্বেচ্ছাসেবক

ট্রেনের টিকিট কাউন্টারে আমি দেখেছি একজন স্বেচ্ছাসেবককে এক ঘণ্টা ধরে আর্জেন্টাইন এক পর্যটককে সহায়তা করতে, যিনি স্প্যানিশ ছাড়া কোনো ভাষাই জানেন না। কত কিছু বুঝিয়ে তাঁকে অবশেষে পুরো ভ্রমণের টিকিট কেটে দিলেন, বিরক্তির কোনো প্রকাশ ছাড়াই। আলাপ হয়েছিল সেই স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে। নামটা মনে করতে পারছি না। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ৪০ দিনের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হয়েছেন। তাঁর কাজটা ট্রান্সপোর্টে। মূলত স্টেশনগুলোতে যাত্রীদের সহায়তা করতে দিনে গড়ে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন তিনি। জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন স্বেচ্ছাসেবক হলেন, কীভাবে হলেন? জানলাম এবার ১৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের জন্য আবেদন পড়েছিল পৌনে ২ লাখ।

—এত আগ্রহ?

বিশ্বকাপে বাংলাদেশী স্বেচ্ছাসেবক কবির
বিশ্বকাপে বাংলাদেশী স্বেচ্ছাসেবক কবির

—বিশ্বকাপের মতো আয়োজনের অংশ হতে পারা এক্কেবারে ‘ওয়ান্স ইন লাইফটাইম’ সুযোগ। সবচেয়ে বড় কথা হলো এই বিশ্বকাপ সারা পৃথিবীর কাছে রাশিয়াকে তুলে ধরছে। দেশের জন্য কাজ করার বিরাট সুযোগ এটা।

স্বেচ্ছাসেবকদের বিভিন্ন মেয়াদে ১ থেকে ৩ মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অনেককে ইংরেজি শেখানো হয়েছে। বিশ্বকাপ শেষে তাঁরা সবাই একটি সনদ পাবেন ফিফার কাছ থেকে।

স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে স্কুলপড়ুয়া থেকে শুরু করে আছেন ৭০ বছরের অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও। তবে বেশির ভাগই স্কুল-কলেজপড়ুয়া। তাঁদের ৬৪ শতাংশই নারী। আর স্বেচ্ছাসেবকদের ৯৩ শতাংশ রাশিয়ান। আছেন প্রায় ১ হাজার ২০০ বিদেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁরা এসেছেন ১১২টি দেশ থেকে। সেখানে বাংলাদেশিরাও আছেন। কাজান শহরে আমার দেখা হয়েছিল দুজন বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে। এন এইচ নোমান ও কবির। রাশিয়ায় পড়াশোনা করছেন এন এইচ নোমান। আর কবির পড়ছেন মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁরা জানালেন, কাজানে বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবক তাঁরা দুজনই। তবে অন্য শহরে আরও অনেকে আছেন।

নোমান
নোমান

—কীভাবে এই সুযোগ পেলেন?

—বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট, অলিম্পিকসহ বড় আয়োজনগুলোতে বিভিন্ন দেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার আবেদন গ্রহণ করা হয়। সেই আয়োজনের ওয়েবসাইটে গেলেই আবেদনের বিস্তারিত জানা যায়। সাধারণত এই প্রক্রিয়া শুরু হয় বছরখানেক আগে।

স্বেচ্ছাশ্রমে অভিজ্ঞতা, নেতৃত্ব ইত্যাদি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় স্বেচ্ছাসেবী নির্বাচনে। বন্ধুসভায় আমাদের সবারই এই যোগ্যতা কম-বেশি আছে। একটু খোঁজখবর রাখলে আগামী বিশ্বকাপে বন্ধুসভার বন্ধুদেরও দেখা যেতে পারে বিশ্বকাপের বন্ধু হয়ে।

সদস্য, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ